কাছে, তবু কত দূরে

সুনির্মল ও রঞ্জনার বিয়েটা মূলত ঠিক করেছিল দুই পরিবার। ফলে তারা বিবাহের আগে কখনোই সেভাবে সুযোগ পায়নি একে অপরকে জানার কিংবা একে অপরকে চেনার। কথায় বলে, বিবাহ কেবলমাত্র দুজন ব্যক্তির মিলন নয়, দুটো পরিবারের মিলন। হিন্দু শাস্ত্র মতে যখন আগুনকে সাক্ষী রেখে সুনির্মল আর রঞ্জনা সপ্তপদী তে বাঁধা পড়েছিল কিংবা হোমের মাধ্যমে বিয়েকে সুনিশ্চিত করে সুনির্মল যখন রঞ্জনার সিঁথিকে রাঙিয়ে তুলেছিল, তখন অন্য সাধারণ মানুষগুলোর মত ওদেরও স্বপ্ন ছিল একটা সুখের ঘরের।  রঞ্জনার কোনোদিনও ইচ্ছে ছিল না চাকরি করার, তাই সে  চেয়েছিল মন দিয়ে সংসার করতে, সুনির্মলের উন্নতির সিঁড়ি হতে। আর সুনির্মলও তো চেয়েছিল এমনই মেয়ে। সে তার সংসার দেখবে, তার মা-বাবাকে দেখবে আর সুনির্মল করবে মন দিয়ে চাকরি। কিন্তু, বিধাতা করেছিলেন পরিহাস। তাই তো  ঘরের স্ত্রী আজ তাকে টেনে নিয়ে গেছে আদালতে। করেছে তার ধৈর্যের পরীক্ষা। কিন্তু, সুনির্মলকে এই পরীক্ষায় জিততেই হবে।

দেখতে দেখতে চলে এল আদালতে শুনানির দিন। আদালতের নির্দেশে আজ রঞ্জনাকে আনতেই হবে দীপশিখাকে। সুনির্মল তাই গতকালই চলে এসেছিল মুম্বই থেকে। ধোপদুরস্ত হয়ে মেয়ের জন্য পোশাক, চকোলেট আর  খেলনা নিয়ে সে হাজির দুপুর বারোটাতেই। আদালতে মামলা শুরুর সময় দুটো হলেও তার যেন তর সইছিল না। কিন্তু, সে চিন্তায় পরে গেল একটা কথা ভেবে। দীপশিখা তাকে চিনতে পারবে তো? যে শিশুটা কোনোদিন বাবাশব্দটাই জানল না, সে কি তবে তাকে বাবা বলে ডাকবে? আদালতে ভিড়ের মধ্যে সে কি করে মেয়েকে কাছে নেবে? কেমন ভাবেই বা তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করবে? এতসব প্রশ্ন ভেবে আকুল সুনির্মল খানিকটা বিরক্তই হল। আদালতের কি উচিৎ ছিল না দীপশিখাকে বাড়িতে নিয়ে যাবার অনুমতি দেবার। তবে কি বিচারক মহাশয়া মহিলা বলেই এমন করলেন? কিন্তু, পরক্ষনেই তার মনে হল, সত্যিই তো দীপশিখাকে নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেই বা কি সে যেত? অজানা, অচেনা মানুষের কাছে সে যাবেই বা কেন? সুনির্মলের একটু শান্ত হওয়ার প্রয়োজন। সে ভাবলো একটা সিগারেট খেলে হয়ত চাপটা একটু কমবে। কিন্তু, পরক্ষনেই সে ভাবল, না, সিগারেটের গন্ধমাখা মুখ নিয়ে সে কিভাবেই বা দীপশিখাকে আদর করবে? সে চুপ করে গিয়ে বসলো আদালত কক্ষে। বিচারক মহাশয়া তখন লিখে চলেছেন সাক্ষী। দুই আইনজীবীর মাঝে মাঝে বাক বিতন্ডা সুনির্মলকে খুব বিরক্ত করে তুলছিল। সে শান্ত হবার চেষ্টা করল। কিন্তু, রঞ্জনা তো এখনো এল না। তবে ও কি আজও আসবে না? আজও কি সুনির্মল তবে দীপশিখাকে পাবেনা দেখতে?

দেখতে দেখতে আড়াইটে বেজে গেল। কিন্তু, রঞ্জনা তবু এলো না। আদালত খুব বিরক্ত হলেও ডাক্তারের দেওয়া রঞ্জনার মায়ের দুকলম অসুস্থতার ফিরিস্তি দেখে বাধ্য হলেন শুনানি মুলতুবি রাখতে। সুনির্মলের আইনজীবীর চিৎকারেও কোন বদল এল না। ডাক্তারের সার্টিফিকেট টা যেন সুনির্মলকে ভেংচি কেটে বলল, ‘কিরে? পারলি কিছু করতে?’ সুনির্মল আজকে সত্যিই মানসিকভাবে  ভীষণ বিদ্ধস্ত। তার মনে হল, যতই আজ সে তার কোম্পানির উচ্চ পদ-মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হোক না কেন, তার স্ত্রীর কাছে সে খেলনার পুতুল। যাকে সে যখন -তখন, যেখানে-সেখানে তুলতে পারে,  আবার পারে নামাতেও। আদালত থেকে বেরোনোর সময় আজ যেন সুনির্মলের মাথাটা সামান্য টলে গেল। উত্তেজনার বশে চলে আসা না খাওয়া পেটটার জন্য গা টা যেন গুলিয়ে উঠল। গাড়িতে উঠে সম্পূর্ণ হেরে যাওয়া মানুষটা গাড়ির এ.সি টাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল। উঠে একটু থিতু হয়ে সুনির্মল একটা কথা ভেবে নিলো। না। অনেক হয়েছে। আর লড়াই নয়। দরকার নেই আর তার পিতৃত্ত্বের স্বাদ পাওয়ার। দরকার নেই আর সুখের সংসারের। কাল সে রঞ্জনাকে জানিয়ে দেবে যে সে আর মেয়েকে পাওয়ার লড়াইয়ে নেই। করুক ও মেয়েকে একাই মানুষ। এবার সুনির্মল মুক্তি চায়। সব বন্ধনের থেকে মুক্তি চায়। রঞ্জনাকে সে আপোসের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুরোধ জানাবে। বিকালে বাড়ি ফিরে ঘুম দিয়ে এখন সুনির্মল অনেকটাই চাপমুক্ত। ওর বিশ্বাস রঞ্জনা তার প্রস্তাবে আপত্তি করবে না। 

কন্যা হওয়ার পর থেকেই রঞ্জনার বাচ্চার সবই দেখভাল করতেন ওর মা। ছোট বয়স থেকে রঞ্জনার উপিস্থিতি সত্ত্বেও রঞ্জনার মা ই ছিলেন দীপশিখার মা আবার দিদিমা। রঞ্জনার আজও মনে আছে দীপশিখা যেদিন প্রথম হাঁটতে শিখেছিল, ওর মা সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছিলো। নিজের সন্তান রঞ্জনার হওয়ার পর ওনার শাশুড়ির অত্যাচারে, সংসারের তীব্র চাপে রঞ্জনাকে উনি কোনোদিনও কাছে নিতে পারেননি। বাচ্চাটা কখন জন্মের পর থেকে বড় হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করল, মা হয়েও তিনি সেটা বুঝতে পারেননি। একদিন রাতে রঞ্জনা তার মায়ের কাছে শোওয়ার বায়না করছিল। তবু তার ঠাকুমা তাকে নিয়ে চলে গেছিলো তাদের কাছে। রঞ্জনার বাবার নীরবতা, উদাসীনতা তার মায়ের মনকে  ভেঙে দিয়েছিলো। তাই দীপশিখাকে যেদিন প্রথমেই হাতে পেয়েছিলেন, ওর মাধ্যমেই তিনি যেন রঞ্জনাকে পেয়েছিলেন। তার জীবনের না পাওয়া সমস্ত আশা-আকাঙ্খা সবই তিনি পেতে চেয়েছিলেন দীপশিখার  মাধ্যমে।

দীপশিখা বড় হবার সাথে সাথে মায়ের তার সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহ দেখে রঞ্জনা প্রমাদ গুনেছিল। সে মাকে বুঝিয়েছিলো দীপশিখা এ বাড়ির নয়। ও যে সুনির্মলের। তাই ওদের একদিন চলে যেতেই হবে। কিন্তু, তার মায়ের নাতনির প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা ততদিনে তার কাছে পাগলামির পর্যায়ে চলে গেছে।  রঞ্জনাকেও দীপশিখার ব্যাপারে অবিশ্বাস করাটা তাকে বিরক্তির শেষ পর্যায়ে নিয়ে চলে গেছিল। সে ক্রমশ বুঝতে পারছিল যে জল ক্রমশ নাকের ওপরে ওঠার পথে। কিন্তু তবু যেন সে মাকে বোঝাতে পারছিল না।  সে বারবার চাইছিল সুনির্মল এর কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু তারপরেই দীপশিখা কে ছেড়ে মায়ের কি অবস্থা হবে ভেবে সিউরে উঠতো। সে নিজেই চেয়েছিল আদালত তাকে বাধ্য করুক সন্তান নিয়ে স্বামীর কাছে ফিরে যেতে। সে মন থেকে চেয়েছিল মেয়েকে নিয়ে সুনির্মলের কোলে তুলে দিতে। কিন্তু হঠাৎ করে মায়ের জ্বরে সবকিছু যেন গুলিয়ে গেল। নাতনিকে নিয়ে স্বামী হারার দুঃখ ভুলে থাকা বিধবা মহিলার কাছ থেকে বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়া যে দুষ্কর হবে, বাবার বন্ধু সমীর কাকু আগেই রঞ্জনা কে বলেছিল। এমনকি মানসিক রোগের ডাক্তারের সাহায্য নিতেও সমীর কাকু বারবার বলেছিল। কিন্তু রঞ্জনা যেন নিজের মাকে কোনোভাবেই মানসিক রোগী বলে ভাবতে পারেনি। 

মায়ের জ্বর টা শেষ সাত দিনে একবারের জন্যও কমেনি।  বেড়েছে ভুল বকা। জ্বরের ঘোরেই মার দীপশিখা কে আদর করে ডাকা সোনা মাকে নিয়ে নানান কথা বলাটা যেন বেড়েই চলেছে।  ডাক্তার ডেকে আনলেন সমীর  কাকু। ডাক্তার দেবাশীষ রায় বোঝালেন ভীষণ শক এর প্রভাবে রঞ্জনার মায়ের এই প্রবল জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো রঞ্জনার মাকে।  কিন্তু আদালতের রায়ে দীপশিখাকে কাছ ছাড়া করার ভয়ে ভীত রঞ্জনার মাকে আর গেল না বাঁচানো। মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওরের কারণে তিনি চলে গেলেন সব মায়ার বন্ধন কাটিয়ে। নিজের জীবনে বঞ্চিত মানুষটা জীবনের যে শেষ সম্বলকে আঁকড়ে থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন, তাকে হারাবার ভয়ে আজ নিজেই সকলের কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। 

রঞ্জনা মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেই সুনির্মলকে ফোন করেছিল দীপশিখাকে দেখভালের জন্য। সুনির্মল স্ত্রী কথা ভেবে যথাসম্ভব তার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিল তার শাশুড়িকে বাঁচাবার। কিন্তু পারেনি। মৃত্যুপথযাত্রী কে ফিরিয়ে আনতে না পারলেও সুনির্মল পেরেছিল অঞ্জনাকে তার কাছে ফিরিয়ে আনতে। সে পেরেছিল স্ত্রীর তার প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে। শ্রাদ্ধবাসর কাটিয়ে শেষদিন অবধি সে অফিসে ছুটি নিয়ে পালন করেছিল তার সকল দায়িত্ব। তাই তো শেষে সে সুদূর মুম্বইয়ে একা নয়, ফিরেছিল রঞ্জনা আর দীপশিখাকে নিয়েই।

দশ বছর পরে:-

——————-

সামনের বছরেই দীপশিখা দিতে চলেছে বোর্ড এগ্জামিনেশন। তাই আজ রঞ্জনা দীপশিখার পড়া, খাওয়া দাওয়া সব কিছু নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। খুশির খবর দীপশিখার পর রঞ্জনার কোল আলো করে এসেছে দীপ নারায়ন। রঞ্জনা আর সুনির্মল এর পুত্র সন্তান। দেখতে দেখতে সেও পড়ে ক্লাস থ্রি এ। সুনির্মল ফিরে এসেছে কলকাতায়। গত বছর ও হারিয়েছে ওর মাকে। না। ওর কোন আফশোষ নেই। রঞ্জনা শেষ দিন অবধি মাকে বুকে আগলে রেখেছিল। যাবার আগে নাতি-নাতনি নিয়ে মা খুব খুশি ছিল। মায়ের শেখানো হে নূতনগানটা দীপশিখা সত্যিই খুব ভালো গায়। এত আনন্দের মধ্যে সুনির্মলের দুঃখ একটাই। তাই ঈশ্বরকে সে বলে, শান্তিই যখন দিলে একটা প্রাণের বিনিময়ে কেন? ভাবতে ভাবতে তার চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। 

                               [সমাপ্ত]

 

Profile Sourov photo

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

লেখক পরিচিতির জন্য ক্লিক করুন

 

 

 

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!