কাছে, তবু কত দূরে

দেখতে দেখতে কেটে গেল চার চারটে বছর। সুনির্মল ও রঞ্জনার একমাত্র কন্যা দীপশিখাও তার বাবা ও মার জীবনে জ্বালাতে পারল না আনন্দের আলো। স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে মেয়ের জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই না নিতে পারার দুঃখে সুনির্মল তখন কাতর। ইতিমধ্যে দুটি মানুষের ব্যবধান যে কখন ভালোবাসা শব্দটা তাদের পৃথিবী থেকে মুছে দিয়েছে, তা চরিতার্থ করার আগেই ধীরে ধীরে তারা বুঝতেও পারলো না যে কখন তাদের মাঝে তিক্ততা জায়গা করে নিয়েছে। সুনির্মলের বাবা মার বয়স ততদিনে তাঁদের শরীরে থাবা বসিয়েছে। রঞ্জনার বাবাও  ততদিনে শিকার হয়েছে নানান ব্যাধির। তবে কি এই মানুষগুলো শেষ জীবনেও পাবে না একটু শান্তির সন্ধান?

কথায় বলে দুর্ভাগ্য কখনো একলা আসে না। আসে দলবদ্ধ ভাবেই। সহ্যের সীমার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া সুনির্মল ততদিনে করে ফেলেছে সন্তানের হেফাজতের মামলা। স্বভাবতই সমন পাওয়ার ফলে রঞ্জনাও তখন মরিয়া। হেফাজত তো দূরের কথা। সে তার সন্তানকে কোন সময়ের জন্যই তার বাবার কাছে ছাড়তেও নিমরাজি। কিন্তু, ভাগ্গদেবতা তাদের অলখ্খে করেছিলেন পরিহাস। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে সুনির্মল ও রঞ্জনা দুজনেই হারালো তাদের বাবাদের। অবশ্যম্ভাবি ভাবেই এক কালবৈশাখি ঝড় এসে যেন তোলপাড় করে দিয়ে গেল দুটো পরিবারকেই। যাক, তবে হয়ত এইবার দুই পরিবারের তরফ থেকেই আসবে যুদ্ধবিরতির ডাক। কিন্তু, না প্রাথমিক টালমাটাল পরিস্থিতি কাটিয়ে সুনির্মল এবং রঞ্জনা দুজনেই আবার শুরু করলো যুদ্ধের প্রস্তুতি। মুম্বইয়ে চাকুরী, কলকাতায় মামলা, সদ্য বিধবা মায়ের তাঁর স্বামীগৃহ ত্যাগের অনীহা, আদালতে বিচারকের শূন্যতা, অফিসে কাজের তীব্র চাপ ততদিনে সুনির্মলকে প্রায় কাবু করে ফেলেছে। কিন্ত না। ভালোবাসা থেকে তিক্ততার মাধ্যমে সম্পর্কটা তখন যে চলে এসেছে ঘৃণার পর্যায়ে। শিক্ষা রঞ্জনাকে দিতেই হবে। তার এবং তার সন্তানের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? ইতিমধ্যে রঞ্জনার খোরপোষের  মামলা ক্রমশ: পরিস্থিতিকে করে তুলছে আরো জটিল। সুনির্মল ভেবে কুলকিনারা পায় না যে, তার সাথে যদি কেউ থাকতে না চায়, এমনকি তাকে পিতা হিসাবে কোনও রকম দায়িত্ব পালন করতেও যদি না দিতে চায়, তবে কোন অধিকারে সে অর্থের দাবি করে? সে এর শেষ দেখেই ছাড়বে।কিন্তু, তবু কি একবার মীমাংসার চেষ্টা করা যায় না? পারস্পরিক বিবাদকে কিছুটা দূরে সরিয়ে কি রাখা যায় না? শেষ চেষ্টা করে দেখাই যাক্ না।

দুই পক্ষের আইনজীবীর প্রচেষ্টায় বরফ কিছুটা গলল।রঞ্জনা অবশেষে রাজি হলো সুনির্মলের সামনে বসার।যে কোনো পারিবারিক সমস্যায় বিশেষ করে বিবাদমান স্বামী ও স্ত্রীর সাথে সবসময়ই কিছু পরামর্শ দাতা আশে-পাশে  বিরাজ করে। তাদের মহান দায়িত্ব থাকে যে কোন উপায়ে পাকা ঘুঁটি কে কাঁচিয়ে দেবার। বিধবা মা, ছোট বাচ্চা নিয়ে জেরবার রঞ্জনারও এমন পরামর্শদাতার অভাব ছিল না। তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত বিচারবুদ্ধি রঞ্জনাকে আবার ভাবতে বাধ্য করল “তবে কি এটা সুনির্মলের নতুন কোন চাল?” তাই সে প্রাথমিক ভাবে রাজি হলেও আবার নানান অছিলায় পিছোতে লাগলো মুখোমুখি বসার দিনটাকে। 

ইতিমধ্যে সুনির্মল ও জুটিয়ে ফেলেছিলো এমন এক পরামর্শদাতাকে যে তাকে সংখ্যাতত্ত্ব বিচার করে বুঝিয়ে ছিল ঘটনার বিলম্বতা সমস্যাকে দূরীভূত করবেই না। বরং তাতে কমবে সমাধানের সম্ভাবনা। ফলে জ্যোতিষ এবং সংখ্যাতত্ত্বে হঠাৎ বিশ্বাসী সুনির্মল তখন মরিয়া হয়ে চেষ্টা শুরু করল রঞ্জনার সাথে সরাসরি যোগাযোগের। ফল হলো ভয়ঙ্কর খারাপ। একদিন মধ্যরাতে খানিক বেসামাল সুনির্মল এর ফোনালাপের প্রচেষ্টা শেষ হলো পুলিশের কাছে অভিযোগ এর মধ্যে দিয়ে। সূচনা হলো বধূ নির্যাতনের নতুন মামলা। ছাড় পেলেন না সুনির্মল এর সদ্য-বিধবা মাও। অফিসের কাজে সুদূর বেঙ্গালুরুর হোটেল থেকে যোগাযোগের চেষ্টা রূপ পেল এমন অভিযোগের যেখানে রঞ্জনা পুলিশকে জানাল মধ্যরাতে হুমকির পরের দিন সুনির্মলের হাতে তাকে হতে হয়েছে লাঞ্ছিত এবং প্রহৃত।

ফোনের বিল, হোটেলের বুকিং এবং সর্বোপরি তার কোম্পানির বেঙ্গালুরু যাওয়ার নির্দেশ খুব সহজেই রঞ্জনার অভিযোগকে প্রাথমিকভাবে খন্ডিত করতে সাহায্য করল।  ফলে সুনির্মলের সহজেই মিলল জামিন।  ইতিমধ্যে দেওয়ানী আদালত রঞ্জনাকে নির্দেশ দিলেন সন্তানকে নিয়ে আদালতে হাজির হবার। ফলে ক্রমশ চাপ বাড়তে লাগলো রঞ্জনার ওপর। কিন্তু, তবু তাকে টলানো গেল না। সে কোন মূল্যেই তার মেয়েকে তার বাবার সাথে ছাড়তে রাজি নয়। তবে এর শেষ কোথায়?

রঞ্জনা ও তার মা এর নয়নের মণি দীপশিখা কি তবে কোনোদিনও অনুভব করবে না তার বাবার ভালোবাসা? সচ্ছল বাবার মেয়ে হয়েও কি সে বঞ্চিত হবে সকল স্বাচ্ছন্দ্য থেকে? কেনই বা রঞ্জনার সুনির্মলের প্রতি এত অনীহা? তবে কি সুনির্মলের জীবনে এমন কেউ বা এমন কিছু আছে যার জন্য সে আজ পিতৃসুখে বঞ্চিত? 

 

(ক্রমশ)

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!