debesh ray

সদ্যপ্রয়াত দেবেশ রায়’কে নিয়ে স্মৃতিচারণা

আমি কোন অধ্যাপক বা বাংলার শিক্ষক নই যে দেবেশ রায়’কে নিয়ে তাঁর উপন্যাস বা গল্প নিয়ে আলোচনা করব। তবে আমার বাড়ির দু’কিলোমিটারের মধ্যেই তিনি থাকতেন। পায়ে হেঁটেই তাঁর ‘বল্মীক আবাসনে’ পৌঁছেছিলাম একটা পত্রিকা দিতে। পত্রিকাটি ‘ভাষাবন্ধন’। যার সম্পাদক ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। রাজীব [রাজীব চক্রবর্তী] আমাকে নিয়েছিল ‘ভাষাবন্ধনে’ । কয়েক মাস জড়িয়ে ছিলাম পত্রিকাটির সঙ্গে। একদিন বাপ্পাদা [নবারুণদা’র ডাক নাম] বললেন, তোর বাড়ি তো বাগুইয়াটি, তোকেই দায়িত্ব দিলাম এই পত্রিকাটা পৌঁছে দেওয়ার। তখনও পর্যন্ত দেবেশ রায়ের দু তিনটি গল্প আমি পড়েছি। ততদিনে তিনি ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ লিখে সাহিত্য অকাদেমি পেয়েছেন। না, তখনও আমার পড়া হয় নি। মনে মনে ভাবছিলাম যদি উনি জিজ্ঞেস করেন পড়েছ আমার লেখা? কি বলব? যেটুকু পড়েছি তাও তো ভুলে যাই অনেকটা। ঝালিয়ে নিতে হয় বারেবারে। খারাপ স্টুডেন্টের মতই। কিন্তু একটা পত্রিকা ওনার হাতে পৌঁছে দিতে সেসব কিছুই করতে ইচ্ছে করেনি। তাই বাপ্পাদার কথামত চলে গেলাম দেবেশ রায়ের বাড়ি। যাওয়ার পথে মনে করতে করতে গেলাম ‘উদ্বাস্তু’ গল্পটা। সত্যব্রত’র সেই দশা আজও আমায় তাড়া করে বেড়ায়। “বলেন কেন আর। গবমেন্ট থেকে অর্ডার এসেছে, তোমাদের দেশে – মানে শহর, আবার সীমান্ত শহর কিনা – আমরা খবর পেয়েছি তোমাদের ওখানে লোক আছে যারা আসলে সে লোক নয়”।  যারা আসলে সে লোক নয় । এই কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। হ্যাঁ, আমি এদেশীয় হওয়া সত্বেও। ওই লাইনটার মধ্যে যেমন যন্ত্রণা আছে। আজীবন কুরেকুরে খাওয়া আছে। তেমনই আছে রাজনীতি। ভোটের রাজনীতি। ভোট এলে বারেবারে তোমায় প্রমাণ করতে হয় তুমি এদেশেরই লোক। হ্যাঁ লোকই। এসব ভাবতে ভাবতেই হয়ত পৌঁছে গেছিলাম দেবেশ রায়ের বাড়িতে। না, উনি এসব কিছুই জানতে চাননি। জিজ্ঞাসা করেছিলেন ভাষাবন্ধনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কিভাবে। রাজীব চক্রবর্তী’র কথাই বলেছিলাম বেশী। ও কবিতা লেখে,  গান লেখে, গ্রাফিক্সের দারুণ কাজ করে। এসব বলেই নিজের ভেতর থেকে হাল্কা হয়েছি আমি। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাড়ি কোথায়? বলেছিলাম বাগুইয়াটির ওপাড়ে জ্যাংড়ায়। হেসে বলেছিলেন, ওমা, তুমি তো আমার প্রতিবেশী। আসতে বলেছিলেন ফের। যাওয়া হয়নি।

দেবেশ রায় প্রয়াত হয়েছেন বৃহস্পতিবার [১৪.০৫.২০২০] । দেশব্যাপী লকডাউনের মাঝেই। ফের ভয় হয়। ভয় হয় লকডাউন শেষ হলে ফের ফিরবে নাতো।

সেই ঘর, সেই বাড়ি, সেই পরিবার, সেই সুখ, পা-গজানো রাক্ষসের মতো সত্যব্রত – অণিমার চারিদিকে আচ্ছন্ন করে তোলে এবং সেই ক্রমঘনিষ্ঠ অন্ধকারের আকাশে নিঃশব্দ ঘোষণা – তুমি, তুমি নও সত্যব্রত; তুমি, তুমি নও অণিমা”।

আমরা খবর পেয়েছি তোমাদের ওখানে লোক আছে যারা আসলে সে লোক নয়। যারা আসলে সে লোক নয়”।

এই তিনটে লাইন আজও মনে আছে। যে মানুষগুলোর কথা আসলে ভুলে যেতে চাই। তাদের কথাই মনে করিয়ে দিতেন দেবেশ রায়। হয়ত বলতে চাইতেন এরাও তোমার প্রতিবেশী।  

এখানেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা।

error: Content is protected !!