virus

মেঘলা আকাশ, ভেজা ভেজা চারপাশ আর ভাইরাস, সব কিছুর কেমন একটা আলগা যোগসূত্র আছে। ঝকঝকে রোদ ভরা দিনে এমনিই সব ভালো লাগে, আত্ম্যপ্রত্যয় টইটুম্বুর থাকে, বিশ্বাস অটল। আজকাল যেন অলসতা পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে, রুটিনের তো বালাই নেই বললেই হয়। সব কিছু একঘেয়ে, ঘোলাটে। কাজের লোক কেউ নেই তাই সারাদিন প্রচন্ড খাটুনি। কাজ সেরে বিকেল বেলা এক কাপ সুবাসিত দার্জিলিং চা নিয়ে বাগানে সাজানো কফি টেবিলে গিয়ে বসেন সুনেত্রা দেবী। এই শেষ বয়সে এসে এই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে কোনোদিনও ভাবেন নি তিনি। এই তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অদ্ভুত এক আত্মোপলব্ধির সময়।

 

এর মধ্যে আবার মানুষটা হাঁটতে বেরোলো, ৭০ পার করেও শৈলেনবাবুর এই হাঁটা থামানো যায়নি, এক হাতে লাঠি নিয়েই ঠুক ঠুক করতে করতে বেরিয়ে পড়েন বিকেল হলেই। আগে কিছুতেই লাঠি নিতে চাইতেন না, একটা ঘটনার পর বাধ্য হলেন। বছর দশেক আগে অবসর নেবার পর বারুইপুরের কাছাকাছি একটা বেশ বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি বানিয়ে ফেললেন, বাড়ি ছোটো, বাগান অনেকটা। চিরকাল বড়ো বড়ো সরকারি বাংলোতে থেকে অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছিলো, তাই ফ্ল্যাটে কিছুতেই থাকা সম্ভব হলোনা। দুই ছেলেই লন্ডনে, খুব ঝোলাঝুলি করলো মা বাবা কে বেশীর ভাগ সময় তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে রাখতে। ওনারা কেউই রাজি হন নি, এই যে দূরে থেকে বৌমাদের সঙ্গে একটা মধুর সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয়েছে একসঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগলে যদি সেটা ভেঙ্গে যায়? তাছাড়া লন্ডনে বাবা মার নাগরিকত্ব পাওয়া যাবেনা, ট্যুরিস্ট ভিসায় বার বার যাতায়াত করতে হবে, প্রচুর ধকল, তার চেয়ে এই বেশ আছেন দুটিতে।

 

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে অন্য একটা গলির প্রান্তে একটা ভাটিখানা, পাড়ার রিকশাওয়ালাগুলোর ঠেক, পাতাও খায় বোধ হয়। দুপুরটা একটু ঝিমিয়ে আবার সওয়ারীর খোঁজে বেরিয়ে পরে চোখ লাল, চর্মসার মানুষগুলো। একদিন একটু শর্টকাট করবেন বলে শৈলেনবাবু ওই গলিতে ঢুকে পড়েন, এমনিতেই কোমরে সায়াটিকা , সারা শরীরে আর্থ্রাইটিসের ছোবল, ফলতঃ একটু বেঁকে হাঁটেন, কখনো বা ব্যালান্স রাখতে গিয়ে একটু টলে যান। সেদিনও তাই হলো, আর একটু হলেই পড়ে যেতেন, হঠাৎই এক খ্যান খ্যানে কর্কশ স্বর,

 

আ মোলো যা, সাঁঝ না লেগতেই মিনসে গিলে মরেচে”…

 

তাকিয়ে দেখেন বস্তিবাসী এক বৃদ্ধা তাঁকে কটমট করে দেখছেন। অপ্রস্তুতের একশেষ, বুড়ি ভেবেছে ওই ভাটিখানা থেকেই ফিরছেন তিনি। এরপর থেকে আর একদিনও “লাঠিটা নিয়ে বেরিও গো” বলতে হয়নি সুনেত্রা দেবী কে।

 

লকডাউনে বেরোনো বন্ধ, কিন্তু এদিকটা খুব নির্জন, আর বেশীর ভাগই বাগান, খাল, বিল, তাই শৈলেনবাবু বাবু ৪’টে নাগাদ বেরিয়ে পড়েন একটা মাস্ক পড়ে। আশেপাশে কাউকেই দেখা যায়না, আধঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসেন, তারপর দুজনে একসঙ্গে বাগানে বসে চা খান। 

 

বুঝলে সু, শরীর হলো মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়” শৈলেনবাবু বলেন স্ত্রী’কে। উনিও আর তাই বাধা দেননি। এই অদ্ভুত ভাইরাস বলতে গেলে ওনাদের বেশ অনেকটাই কাছাকাছি এনে ফেললো, জন্মে শৈলেনবাবু কুটোটি নাড়েননি‌ অথচ আজকাল বাথরুম পরিষ্কার করা, গাছে জল দেওয়া, বাজার করা এগুলো করছেন, খাবার পর নিজের থালা, বাটিও ধুয়ে নিচ্ছেন। গলার সুর অনেকটাই নরম, নইলে মেজাজের ভয়ে তটস্থ থাকতেন সুনেত্রা। অকারণ রাগ, তবে শুধু বাড়িতেই, বাইরে উনি মাটির মানুষ। অবশ্য রাগ জল হতেও বেশীক্ষণ লাগেনা।

 

মেঘ করলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়, সুনেত্রা দেবীর কতো কথাই না মনে পড়ে যাচ্ছে আজ। সেই যে দুজনের একই অফিস পাড়ায় কাজ করা, প্রেম ঠিক ছিলনা, ঘোর লাগা চোখে তাকাতেন লাজুক শৈলেন। আলাপ হওয়ার পর মাঝে মাঝে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। একদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, উনি সুনেত্রার অফিসে ফোন করে বললেন “আপনি গড়িয়াহাটে আমার জন্য অপেক্ষা করুন, আমি আধ ঘণ্টা পরে গাড়ি নিয়ে আপনাকে তুলে নেবো, তারপর কোথাও কফি খাবো দুজনে”। সুনেত্রা ঝাড়া দেড় ঘণ্টা ঠায় অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে গেলেন তিরিক্ষি মেজাজে, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির আওয়াজ, তিনিও এলেন। 

 

মা একদম দরজা খুলবে না, আমি ভিজে প্রায় চান করে গেলাম, আর এখন আসা হলো!” সুনেত্রার হুংকার।

আহা তা বললে হয় নাকি? তোর ও যেমন” মা বলেন। ঢুকলেন মূর্তিমান, চোর চোর মুখ, বস্ নাকি কিছুতেই ছাড়েননি, “আরে তোমার আবার কি কাজ? বউ বাচ্চা তো নেই, বসো বসো আড্ডা মারি একটু”… অগত্যা।  সুনেত্রার তখনও সেলফোন ছিলো না।

 

চান করে শুকনো জামা কাপড় পরে বেরোলেন সুনেত্রা, মা লুচি তরকারী পরিবেশন করে ফেলেছেন, সান্ধ্যভোজন।তখন কথায় কথায় শৈলেন জানতে পারলেন যে কালই একটা আলমারি আর একটা শোকেস এ বাড়িতে ডেলিভারী দেবে, উনি দুম করে বলে বসলেন, ” এ গুলোর কি দরকার ছিল? আমার বাড়িতে তো সবই আছে, এগুলো ঢুকবে কোথায়?” হকচকিয়ে গেলেন সুনেত্রা, তাকালেন মানুষটার দিকে, হঠাৎই অন্যরকম কোমল এক দৃষ্টি, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি।

 

এটাই ছিল বিবাহের প্রস্তাব।  

 

রাত ৯ টা নাগাদ বিদায় নিলেন শৈলেন, দরজার কাছ অবধি পৌঁছে দিতে গেলেন সুনেত্রা, মোক্ষম সময়ে লোডশেডিং, এতদিন ভাবতেন সিনেমাতেই শুধু বুঝি হয়। আলতো করে সুনেত্রার হাতটা ধরলেন শৈলেন, তারপরই “গুড নাইট”, বলে গট মট করে স্মার্টলি গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন একবারও পিছনে না তাকিয়ে। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মনটা ভরে গেলো সুনেত্রার, ঘরে এসে সবে শোবার তোরজোড় করছেন এমন সময় ডোরবেল বাজলো, এই সাড়ে ন’টার সময় কে এলো? খুলে দেখেন প্রচন্ড কাঁচুমাচু মুখ করে শৈলেন দাঁড়িয়ে, কি ব্যাপার? খানিকটা গিয়ে নাকি গাড়ি আর স্টার্ট দেয়নি। সাংঘাতিক একটা রোম্যান্টিক সন্ধ্যার কি অকাল মৃত্যু। এদিকে পাড়ার সমস্ত মেরামতির দোকান পাট বন্ধ, কি করা যায়? ওপরের ফ্ল্যাটের বাপ্পা অফিস থেকে ফিরছিলো, সব শুনে বললো “চলো দেখি কোথায় গাড়ি”। তিনজনে সেই অন্ধকারে জল কাদা ডিঙিয়ে চললেন, বেশী দুর অবশ্য যেতে হয়নি। এর পর সুনেত্রা আর বাপ্পা গাড়ি ঠেলতে লাগলেন, শৈলেন স্টিয়ারিং ধরলেন, নাহ গাড়ি এক্কেবারে ন যযৌ ন তস্থৌ। কেলেঙ্কারির একশেষ। 

 

আচ্ছা সাড়ে পাঁচ’টা বাজতে চললো, লোকটা এখনও এলো না কেন? চা তো ঠাণ্ডা জল… ঠিক তখনই বাগানের লোহার গেটটা খোলার আওয়াজ হলো, ধীর পায়ে দীর্ঘদেহী শৈলেন ঢুকছেন, যেন বহু যুগের ওপার হতে… সুনেত্রার বুকের ভেতর সেই পুরনো ভাইরাসটা একটু নড়েচড়ে উঠলো।

 

কল্যাণী ঘোষ, ২৬ শে মার্চ,২০২০

ক্যালিফোর্নিয়া

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!