শব্দ . গল্প . কল্প
তা আপনার গল্পের শুরু টা কোথা থেকে ?
মেয়েটা কফিতে সশব্দে একটা চুমুক দিলো। আমার প্রশ্নটা গা করলো না। এই বাইশ-তেইশ বছরের মেয়েরা লাজুক টাইপ হয়ে থাকে। আর এই মেয়েটা ভদ্রতার বালাই নেই, তার সমস্ত মনযোগ কফিতে। যেন এই মুহূর্তে এক্ষুণি কফি খাওয়াটা সবচে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি গলা কেশে আবার প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিলাম –
আহ্, বড্ড জ্বালান তো। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি? সিগারেট হবে?
মোটামুটি অপমানে আমার শ্যামলা ফর্সা মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি নাকি জ্বালাচ্ছি! অথচ মেয়েটাই বলল, যদি কোনদিন দেখা হয় গল্পটা বলব- কিভাবে আমি এরকম হলাম। দেখতেই পাচ্ছি কেমন বকে গেছে – আসলেই বকে গেছে নাকি ছেলে ভুলানো ভান! কত রকমের মেয়েই আছে। আমার কেন জানি রাগ উঠছে। কফি খাওয়া শেষ হোক আমি উঠে যাবো। আমি তো এর মতো অভদ্র না। জিহ্বা তালুতে লাগিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করল মেয়েটা, যখন আমি উঠে যাচ্ছিলাম।
আহ, জনাব বসুন।
মেয়েদের উপর যত রাগই হোক, তাদের কথা কেন জানি অগ্রাহ্য করা যায় না। কোথায় যেন শুনেছিলাম, আজ নিজের মাধ্যমে প্রমাণ হল। নারী বুদ্ধি সত্যি বোধহয় প্রলংকরী। একটু আগের সূক্ষ্ম অপমান কিভাবে গিলে ফেললাম। পুরুষ হওয়ার মেলা ঝামেলা। নারীর ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য। টাকার গায়ের লেখার মতো ,’ ডাকিবা মাত্র সাড়া দিতে বাধ্য ‘।
দ্বিতীয় মগে কফিতে চুমু দিয়ে মেয়েটা কথা শুরু করল। আমি যদিও উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, কিছুক্ষণ আগের অপমানের প্রতিশোধ নেবার ব্যর্থ চেষ্টায়। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। আমার কান যতটা না গল্প শুনছে তারচেয়ে বেশি আমার চোখ মেয়েটাকে দেখছে। ঠোঁটে হালকা কমলা লিপস্টিক। সবুজ শাড়ির সাথে কমলা, কেমন অন্য রকম লাগছে। চেহারায় তীক্ষ্ণতা সে বোধহয় বুদ্ধিমত্তারই হবে। কিন্তু দেখে চোখে জ্বালাপোড়া করছে। এর সৌন্দর্য স্নিগ্ধ না, জ্বালা ধরানো সৌন্দর্য। কমলা রঙের লিপস্টিক এর পিছনে আছে বলে মনে হচ্ছে ।
আপনি কি আমার কথা শুনছেন?
জ্বি।
বলুন তো, কি বলছিলাম?
ওই যে ভয়ের কথা –
হলো না, আপনি এরকম অমনোযোগী সাইকোলজিস্ট! ধ্যাত।
এখন মনে হচ্ছে আমি সত্যি অকাজের। মেয়েটার কথা শোনা দরকার ছিলো, তা না করে, ছিহ ছিহ। দয়া করে আবার বলুন।
মেয়েটার চোখ টলমল করে উঠলো। এ দেখি অশ্রু কন্যা। তেজী চেহারা, জ্বালা ধরানো রূপ মুহূর্তে চট করে কোমল,নদী নদী ভাব চলে আসলো। এ বোধহয় মেয়েরাই পারে।
সিগারেট খাবেন?
মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হাত বাড়িয়ে দিলো ।তার মানে সে এর আগেও অনায়াসে ছেলেদের কাছ থেকে নিঃসংকোচে সিগারেট নিয়েছে। এবং এই কাজটা সে সামনের মানুষটাকে চমকে দেওয়ার জন্যই করে।
আপনি কি আমার গল্প সম্পূর্ণ মনযোগ দিয়ে শুনছেন?
এবার আমি আর কোন ভুল করলাম না। কারণ এবার সত্যি মনযোগ দিয়ে শুনছিলাম।
হুঁ।
মেয়েটা আবার বলা শুরু করল, আসলে ভয় আর লজ্জা দুটো যখন আমার ভেঙে গেলো তারপর থেকে আমি বেয়াড়া বলতে পুরোপুরি বেয়াড়া হয়ে উঠলাম । সিনিয়র ভাইদের আমি সালাম দিতাম না, রুচিতে বাধত। আর ডিন স্যার ও বলেছিলেন আমাকে যেন আর কেউ র্যাগ দিতে না আসে। আমি চাইলেই পারতাম ইমিডিয়েট চারটা সিনিয়র ভাইয়ের নাম বলে দিতে, ইচ্ছে ও ছিলো তাই। তারপর কি যেন হলো, বললাম – ভুলে গেছি। ডিন স্যার ক্লাস থেকে চলে গেলেন, আমি এক ধাক্কায় হয়ে গেলাম ডিপার্টমেন্ট এর টক অব দ্যা টাউন।
বুঝতেই পারছেন, আমি এমন একটা চরিত্র যেখানে যাবে তার নাম ছড়িয়ে যাবে। সেলিব্রিটি কপাল বলতে পারেন।
বুঝলাম , তারপর?
তারপর যা হবার হল। আপনি সাইকোলজির স্টুডেন্ট, হবু সাইকোলজিস্ট। তীব্র ভয়
আর লজ্জার সম্মুখীন হলে হয় এটা একেবারে বেড়ে যাবে নয়তো একেবারে চলে যাবে। আমার বেলায় দ্বিতীয়টা হলো। আমি অনায়াসে ছেলেদের সাথে মিশতে পারতাম কিন্তু কাছে ঘেঁষতে দিতাম না।
আপনার কি অনেক ছেলে বন্ধু ?
মোটেও না। আমি বলেছি মিশতে পারতাম। তাই বলে কি মিশে যেতাম – এইরকম কিছু তো বলিনি।
হুঁ, পরে –
ওই তো চলতে থাকলো। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এর সিনিয়র ভাইগুলো ডাকত। আমাকে কিভাবে র্যাগ দেওয়া হয়েছিলো সেই কাহিনি শুনে আহা – উঁহু করে। আমি সাবলীল ভাবে চা খাই, মুখে মুখে তর্ক করি।
আর সিগারেট এর অভ্যাস কবে থেকে –
মেয়েটা এক ঝলক হাসল। অদ্ভুত তো লিপিস্টিক একদম মুছে নি, দুই দফা কফি খাওয়ার পর। নিশ্চিত দামী ব্র্যান্ড। জিজ্ঞেস করবো নাকি!
সিগারেট খাইনা তো, আমার সামনে সিগারেট খোর থাকলে ধোঁয়ায় আমার শ্বাসকষ্ট হয়, চট করে সিগারেট চাইলে ছেলেরা ঘাবড়ে যায়। এটা ট্রিকস। তবে সবার জন্য না।
ও আচ্ছা । তারপর –
গল্পটা এখানে শেষ হতেও পারতো, কিন্তু হলো না । মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠল আবার। এই অশ্রুরাশি নিয়ে ভালো বিপদ হলো। আমার সাতাশ বছরের তরুণ প্রাণ হাহাকার করছে। একেই বোধহয় বলে, ‘মুখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা। ‘
বাকিটা বলুন –
মেয়েটা কেন জানি হুট করে ধপ করে জ্বলে উঠল। বললাম, তো ভালো লাগছে না বলে চেঁচিয়ে উঠল।
বিশ্বাস করুন, মেয়েটা কখনো আমায় বলেনি তার ভালো লাগছে না। দিব্যি হাস ছিলো শরৎ এর মেঘমুক্ত আকাশের মতো। আমি লজ্জায় শেষ । ক্যাফের সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো, ভাব এরকম – অপূর্ব আর মেহজাবিনের নাটকের শুটিং চলছে। ভুল হলে মাফ করবেন , আমার আবার নায়িকাদের নাম মনে থাকে না।
টেবিলে মাথা রেখে মেয়েটা চুপচাপ শুয়ে আছে। আমি সত্যিই জানি না এরকম পরিস্থিতিতে কি করা লাগে। কিন্তু প্রগাঢ় মায়ায় মন ভরে উঠলো। আশেপাশে সবাই সবার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো, বাঙালি তো ঘন ঘন নতুন ঘটনা চায়।
ডাক্তার আলতাফ চুপ করে গেলেন।
এসি শীতল রুম। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। উঠে পড়বো কি না – তাও বুঝতে পারছি না। উনার চেম্বারে নিজ থেকে আমায় ইন্ডিয়ান স্পেশাল কফি খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন – এখন গল্পের শেষে থেমে গেলেন। আমি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শূন্য মগে সুড়ুৎ করে চুমুক দিলাম।
আহ, বাস্তবে ফিরল তবে ডাক্তার । আমার দিকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললো, অতীত বার বার ফিরে আসে। কখনো রোগী হয়ে, কখনো প্রণয়ী হয়ে।
উনি কি তবে?
হ্যাঁ, প্রাগাঢ় মায়া থেকে মনে হলো মেয়েটার জীবনে একটা শক্ত হাত দরকার। কিংবা আমারই হয়তো মেয়েটাকে বেশি দরকার । বোধহয় দরকারটা আমারই বেশি ছিলো নয়তো ত্রিশ বছর একসাথে কিভাবে কেটে গেলো।
তারপর ?
উনি হা হা হা করে হেসে বললেন, আপনি তো আচ্ছা গাধা লেখক সব কিছু তো আমি বলেই দিলাম আর কি থাকে – আর যাই বা থাকে নিজে বানিয়ে লেখুন গে। আজ আমার বড্ড তাড়া।
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com