55 haoya badal

এই আপু , শোনো যা মজার কাণ্ড  হয়েছে। এইটুকু  বলে নিশাত হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আমি বিরক্তি  চেপে বললাম , কি হয়েছে সেটা বল। নিশাত কোনরকমে  হাসি চেপে কথাটা শেষ  করল। যা উদ্ধার  করতে পারলাম  মূল কথার তা হচ্ছে  আমাদের  বাসার দু’বাসা পর বড় দোতলা বাড়ির ছোট ছেলেটা চতুর্থ  বিয়ে  করতে যাচ্ছে । অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই । কিন্তু  কাহিনি  সত্যি । তবে দুঃখের  বিষয়  হচ্ছে  তার আগের তিনটা বিয়ে  টিকে নি। এই একবিংশ  শতাব্দীতে ও এরকম  ঘটনা  ঘটে! নিশাত হেসেই যাচ্ছে ।  ঘটনার বাইরের দিক যতটা হাস্যকর, ভেতরটা ততটাই মর্মান্তিক। ভাবছি ছোট্ট  করে একটা ধমক দিবো কি না। সতের পেরিয়ে  আঠারো  হবে ,তার অন্তত এটা বুঝা উচিত  কোনটা হাসির ঘটনা  আর কোনটা দুঃখের । ধমক দিতে  গিয়ে  ও দিলাম না। জানি একটু চুপ থেকে  পরক্ষণেই  হেসে উঠবে। বাঁধ ভাঙা হাসি। বয়সটাই যে এমন।

নিশাতের বলা মজার কাণ্ডের সূত্রপাত ছয় বছর আগে। আরেকটু খুলে বলি। দোতলা বাসার ছোট ছেলে ছয় বছর ধরে এই বিয়ে করা আর ভাঙ্গার খেলা করে যাচ্ছে । এর শেষ  কোথায়  কে জানে। ভাবলেও গা ঘিনঘিন  করে। এরকম অসুস্থ  মন মানসিকতার মানুষ  কি সুন্দর  করে আমাদের  মাঝেই  হেসে খেলে বেড়াচ্ছে । কেবল খুটির জোরে। স্পষ্ট  মনে আছে আমার, আজ থেকে  ছয় বছর আগে আমি ছেলেটার বিয়ের দাওয়াত  পেয়েছিলাম । আচ্ছা, একে ছেলে না বলে লোক বললে মানাবে।  কারণ  ছেলে বলার ছেলেমানুষী  সংজ্ঞা পেরিয়ে  লোকে পরিণত হয়েছে  মি. বাবু ।

কি সুন্দর ফুটফুটে  মেয়ে । আমি হা করে তাকিয়ে  ছিলাম। বউ বুঝি এমন সুন্দর  হয়।  লাল শাড়ি পরে জড়সড়  হয়ে পুতুল বউটা বিছানায়  বসে আছে। চারদিকে  অপরিচিত  মানুষের  ভিড়। তাদের  মধ্যে  আমিও এক অপরিচিত । মেয়েটা বয়সে আমার চেয়ে ও দু’ বছরের  ছোট। আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষার পর থ্রিলারে ডুবে থাকি  আর মেয়েটা সংসারের  হাঁড়ি  – বাটির ভয়ংকর  থ্রিলে জড়িয়ে  গেল চোদ্দ  বছরে।আর সে থ্রিলারের নায়িকা আমার ধরা ছোঁয়ার জগতের।  একি কাণ্ড!  কাণ্ডের আসলে তখন মাত্র শুরু ।

সংসারের  কিছু  শেখো। দেখলে তো ওই পিচ্চি  মেয়েটা এখন ঘরের বউ। তোকে ও তো একদিন  বিয়ে  দিবো, তখন কাজ না পারলে..আমি বই থেকে  মুখ তুলে বলি, ‘ ‘কাজ না পারলে কী? ‘ ‘ মা আর উত্তর  দেন না । আমি আবার বইয়ে ডুব দিলাম । মায়ের মন বড্ড  ভীতু মন।  এত চিন্তা  নিয়ে  কি বাঁচা যায়  নাকি। যা হবার  হবে।  এত ভাবার কি আছে?  কিন্তু  তখন কে জানত আসলেই  যে ভাবার অনেক  কিছু  আছে।

বাইরে বৃষ্টির দুরন্ত বর্ষণ। এর মাঝে ট্যাপে পানি শেষ । মা বাথরুম  থেকে  বলল, ‘যা তো দোতলা বাসায় বলে আয়, আমাদের  কলে পানি শেষ ।“ ওহ, বলি নি  তো, ওই দোতলা বাসার ছোট ছেলেটা আমাদের  বাড়ি ওয়ালার ছেলে।  আমি দোনামনা করে ছাতা নিয়ে  বের হলাম। বাসায়  আমি আর মা ছাড়া দ্বিতীয়  প্রাণী নেই । দ্রুত পায়ে দোতলা বাসার সিড়ি  ভেঙে  উপরে উঠলাম । দরজায় অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর মিষ্টি  চেহারার ছোট  বউ হাজির। আমি বললাম, “ পানি শেষ। “ আমার থেকে  ছোট দু’বছরের ছেলে মানুষী বউটা খিলখিল  করে হেসে উঠল।  আমি বুঝতে পারলাম না পানি শেষ  কাটায় হাসির কি  আছে! 

আমার স্বাভাবিক  নিয়মে মেয়েটার সাথে  ভালো  বন্ধুত্ব হতে পারত। কিন্তু  হলো না।  হয়ত পানি শেষ  কথাটায়  হেসে দিয়েছিল বলে আমার অবচেতন  মন আহত হয়েছিল। এর কিছু দিন  পর মেয়েটা পড়ন্ত বিকেলে  আমাদের  পোকা খাওয়া  দাঁতের বাড়ি ওয়ালীর সাথে  আমাদের  বাসায় হাজির।  মেয়েটা ঘুরে  ঘুরে আমাদের  দুই কামরার বাসা দেখেছিলো।  তারপর  আমার রুমে  যখন উঁকি  দিলো আমি বললাম , “এসো। “ মেয়েটা আমায় অবাক করে দিয়ে  ,আমার রুমে বিছানায় বসল। কাছাকাছি  বয়সের মেয়েদের  আর যাই হোক , কথার অভাব হয় না।  আমি আকাশ – পাতাল খুঁজে কথা পাচ্ছিলাম না।  কিছু তো বলা দরকার , তাই কথার কথা হিসেবেই বললাম, ‘’বই পড়ো?  গল্পের বই?  “ মেয়েটা এমন উত্তর  দিবে জানলে এই কথা ভুলেও জিজ্ঞেস  করতাম  না। আবার ওই দিনের মতো হেসে লুটোপুটি  খেয়ে  বলল, “ ওমা খামোকা বই পড়তে যাবো কেনো? আমার বিয়ে  হয়ে গেছে না।  “ আমি তারচে অবাক হয়ে বললাম, “ তাই  বলে  পড়াশোনা  করবে না? “ আবার খিলখিল  হাসি। যেন বেশ  মজার কথা শুনেছে,আর  এরকম ছেলেমানুষী কথার কোনো  উত্তর হয় না । আমি শেষ  বিকেলের  আলো আর ছোট বউটার মাঝে অদ্ভুত  মিল খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। দুটোই ফুরিয়ে  এল বলে।  

ছেলেটার সেই  চোদ্দ  বছর বয়সী বউটার নাম ঋতু। ঋতুর মতোই সে স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল।  মেয়েটার একটাই  দোষ খামখেয়ালি স্বভাব  আর ঝর্ণার মতো অবিরাম হাসি।  শ্বশুর  বাড়িতে এটাই ছিল মেয়েটার মস্ত দোষ ।  তাই  হুটহাট  আমি যখন  হেসে উঠতাম , মা বলে উঠত মেয়ে মানুষের  এত হাসতে নেই ।  এসব ভালো না।  আমার মন খারাপ  হয়ে যেত। মনে হত আহা বেচারি  ছোট বউ। সংসার  বুঝার আগেই  স্বভাবের হাসির কারণে  সংসার ভেঙে  গেলো।  হাসিটাই ঘর ভাঙার কারণ  হল। আচ্ছা , মেয়েটার ছাব্বিশ  বছর বয়সী স্বামী  কি পারতো না আগলে রাখতে? ঘুণে খাওয়া সমাজে কি সহজে বাল্য বিবাহ  টাকার জোরে  হয়ে হাসির অপরাধে ভেঙে  যায় !

মাসখানেক  পর ছেলেটার দ্বিতীয়  বিয়ের খবর শুনি। এবার নাকি ঠিকঠাক  বিয়ে  হয়েছে। মেয়ে সংসার  বুঝে । অকারণে  হাসে না। শ্বশুর বাড়ি লোকজন  বলে, “ বউ একদম  পান্না! “ বটে,  বউ এর নামই ছিলো পান্না।  আমি মায়ের সাথে  গেলাম  দোতলায় বউ দেখতে। একই বাসা, অথচ মানুষ  এখন ভিন্ন।  আমাকে যথেষ্ট  সম্মান  দেখিয়ে  বলল,” মিষ্টি  খান আপু।“ বয়সে বড় কেউ  এমন বললে বেশ লজ্জা  লজ্জা  লাগে। পোকা খাওয়া  দাঁতে শাশুড়ী  বলল, “ ভাবী এবার জিতছি। “

পান্নার জীবন  কয়লা হতে বেশি  সময় লাগল না ।এবার আরো অল্প সময়ের  ব্যবধানে মূল কাহিনি  বেরিয়ে  এল।  মেয়ের বয়স নাকি লুকানো  হয়েছে এবং  মেয়ের আগে একটি বিয়ে  হয়েছিল। তারচে বড় অপরাধ  মেয়েটির চার বছরের একটি ছেলে নানার বাড়িতে  মানুষ  হচ্ছে , এ খবর গোপন  রাখা হয়েছে। ভয়াবহ  অপরাধ ।  এর সহজ সমাধান  হিসেবে  আবার ডিভোর্স  ।  এবার মেয়ে পক্ষ  একটু শক্ত। দিল একালের বাবু  নামধারী অপুর নামে মামলা টুকে  ।আহা, বেচারা ফেঁসে  গেল।  তিনলক্ষ  টাকার মোটর  সাইকেলের জন্য নাকি এবার বিয়ে  করেছিল !

এরপর  অনেক  জল ঘোলা হল। নদীর পানি কত বয়ে গেল।  আমার ব্যস্ত সময়ে ঋতু, পান্না এদের কথা ভাবার জন্য  আলাদা সময় কই। জীবনের ব্যস্ততার তাগিদে  আমি শহর ছেড়ে ছিটকে পড়েছি। দোতলা বাসাটা যদিও কখনো  চোখে পড়ে মনের ভেতর টা দমে যায়। এটুকুই । আর কি করার আছে।

ভেবেছিলাম  কাহিনি  এখানে  শেষ । কিন্তু  লোক মুখে শুনলাম , কোন এক ঝগড়ার আড়ালে নিষ্পাপ নামের অর্থ বহনকারী বাবু বলেছিলো, “ আমি আমার চাচার মতো তিনটা বিয়ে করবো। “ আমি মনে মনে বলি আলহামদুলিল্লাহ , এবার বোধহয়  টিকে  যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতকালীন  বন্ধ । আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে  জড়সড় । মা বলল, “ চল যাই। “ আমি চশমা নাকে ঠেলে দিয়ে ,  প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকালাম । যা শুনলাম , তার অর্থ বাবু এবার বয়সে বয়সে বুড়ো হতে চললো বলে, তাই তৃতীয়  বিয়ে । এবার আর হাংকি পাংকি না । মেয়ে ষোড়শী ।  আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস চাপলাম। আবার!

মায়ের জোড়াজুড়ি তে এবার ষোড়শী  বাবু বউ দেখতে গেলাম । রাঙা রাজকন্যা সমস্ত রূপ নিয়ে  মেয়ে   বিছানার  বসে কার্টুন দেখছে।  আমরা যাওয়া তে একটু নড়েচড়ে  বসে বলল, “ আম্মা তো বাসায় নাই। আপনারা কি বসবেন? “

নাহ। আর বসা হয়নি, মেয়েটির নাম ও জানা হয়নি। তবে বুঝতে পেরেছিলাম কি হতে যাচ্ছে । যা হয় হোক।

পরিশেষ ।  করোনা মহামারী  । চারদিকে  দূরত্ব  বজায় রাখুন স্লোগানের মার্কেট।  এর মাঝে দূরত্বের অবসান ঘটাতে চতুর্থ  বিবাহ অভিযানে নেমেছেন  ‘ বিবাহ বিশেষজ্ঞ  বাবু’।  

হাওয়া বদল আরকি! 

error: Content is protected !!