josnar pakhi

সিনেমাটা দেখে ফিরে এসে অবধি দারুণ হইচই হচ্ছিলো। অবিনাশদা হিঙের কচুরি আর মাংসের ঘুগনি শুদ্ধু চায়ের ট্রে এনে রাখতেও থামলো না। আমার দুই ননদ, দুই দেওর, জা এবং আমার বর বড় পিসঠাকুমাকে বোঝাতে লাগলো কি ভীষণ রোমাঞ্চকর ছিল সিনেমাটা । এখান থেকে বেশ দূরে সিনেমাহল, পিসঠাকুমা বড়োঠাকুমা কেউ যান নি ।

“সমান্তরাল পৃথিবী, মানে, ইয়ে, চতুর্থ মাত্রা, বুঝলে পিসঠাকমা ?”

“এখান থেকে এক ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল মানে দুবৃত্ত সেখানকার একটা দরজা খুঁজে পেয়ে এক জাদু আংটি কবজা করতে গেছে…সেখানকার সব কিছুই ম্যাজিক…”

“ওটা পেলেই সমস্ত শক্তি ওর হাতের মুঠোয়…”

“হিরো আর তার সুন্দরী বান্ধবী মিলে তার পিছনে ছুটেছে…”

“চতুর্থ মাত্রা মানে বুঝেছো তো পিসঠাকুমা ?” আমার ছোট দেওর অর্চন সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলো।

বড় পিসঠাকুমা হাসি হাসি মুখে কোলের ওপর কুরুশকাঁটা নামিয়ে রেখে বললেন, “বুঝিয়ে বল না শুনি।”

সবাই বোঝাতে লাগলো, আর আমি অন্যমনস্কভাবে ওঁকেই দেখতে লাগলাম । এই বয়সেও টুকটুকে রঙ, ছিপছিপে গড়ন, চুলে বয়সের রূপোলী জ্যোৎস্না, বড়ো বড়ো চোখে হাসির ঝিকিমিকি সব সবসময় । চার ভাই তিনবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিলেন, খুব আদরেরও নাকি । খুব অল্প বয়সে বিধবা হন বিয়ের পরেই । এ বাড়িটা ওঁদের ঠাকুরদার ছিল, প্রিয় নাতনীকে দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সারা জীবনটা এখানেই কাটলো ওঁর, বিয়ের আগেও নাকি এবাড়িতে থাকতেই ভালোবাসতেন । পার্বত্য ছোট্ট শহরের এই বাড়িটা খুব পুরোনো কিন্তু খুব সুন্দর আর অন্যরকম । একেবারে পাহাড়ের গায়ে লাগা বাড়ি, তিন তলা কিন্তু সবগুলো তলা থেকেই বাইরে বেরোনো যায় সোজা, বেরোলেই খানিকটা সমতল জমি, তারপর ঢালু হয়ে নেমে গেছে, মাঝে মাঝে সিঁড়ি, কিছু কিছু ঘর বাড়ি দোকানপাটও আছে । বাড়ির ভেতরেও অনেকগুলো লেভেল, অগুন্তি সিঁড়ি বারান্দা, ঘর । আমার বর সঞ্জু বলেছিলো ছোটবেলায় এখানে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে গিয়ে ওরা অবধারিতভাবে হারিয়ে যেতো, তখন পিসঠাকুমা ওদের খুঁজে বের করতেন । আর কেউ কেউ বলে এবাড়ির অনেকটা নাকি পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে আছে, কিছু বোঝা যায় না…

আমি বলেছিলাম, “কিন্তু এরকম গোলমেলে বাড়ি বানালো কে ?”

“কে জানে…বাড়িটা তো ওঁর ঠাকুরদা মানে আমাদের প্রপিতামহের বাবা কিনেছিলেন, কিসব খনির ব্যবসার জন্য । সে সব আর হয় নি কিন্তু বাড়িটা ছিলো, পিসঠাকুমার খুব পছন্দের ছিলো । এমনিতে জায়গাটা বেশ সুন্দর কিন্তু বড্ড নির্জন, মোটামুটি স্হানীয়রাই থাকে আর এক এক সময় কি ঘন কুয়াশা নামে ভাবতে পারবে না । বিশ্রী ।”

এখন চা ঢেলে দিতে দিতে ভাবছিলাম এরকম জায়গায় উনি প্রায় সারাজীবন এভাবে কি করে কাটালেন । অবশ্য সেকেলে মানুষ হলেও পড়াশুনো করেছিলেন, বাংলা ইংরেজি দুই-ই পড়েন, প্রচুর বই বাড়িতে, আবার চমৎকার সেলাই হাতের কাজ জানেন । এই বয়েসেও ।

ওঁর সঙ্গে দেখা করতেই আমাদের আসা, উনি আমাকে দেখেন নি, তাই ।  বিয়েতে আসেন নি, কোথাও বিশেষ যান-টান না । গুরুজনদের মধ্যে শুধু বড়োঠাকুমা এসেছেন । তিনি এতোক্ষণ সোফায় পা তুলে শাল মুড়ি দিয়ে বসে চশমা এঁটে ফোনে কি সব দেখছিলেন ( এ সব ব্যাপারে দিব্যি ওয়াকিবহাল ), এবার মুখ তুলে বিরক্ত হয়ে বললেন, “একটা পিত্থিমিতে খুনখারাপি করে কুলোচ্চে না, আবার আরেকটাতে গিয়ে আংটি খুঁজতে হবে । তোদেরও বলিহারি বাপু এই সব গাঁজাখুরি দেখে ধন্যি ধন্যি করচিস ।”

আমার ছোট ননদ বৈশালী বললো, “তার মানে তোমরা বিশ্বাস করছো না তো যে আরেকটা মাত্রা থাকতে পারে ? আর এদিকে যে ভূতে বিশ্বাস করো তার বেলা ?”

ঠাকুমা বললেন, “ অ মা, ভূতে বিশ্বেস করবো না কেন তাই বলে ! জানিস আমার মামার বাড়িতে ভূত গিজগিজ করচে, কত্তো লোক স্বচক্ষে দেখেচে। দেখা তো তোর মাত্রার দরজা না কি যেন । এঃ, অবিনেশ আজ চা-টা বড্ড কড়া করে ফেলেচে বড়ো ঠাকুজ্যি !” বলে সুড়ুৎ করে আবার চায়ে চুমুক দিলেন ।

“পিসঠাকুমা, তুমিও মনে করো আরেকটা সমান্তরাল পৃথিবী থাকতে পারে না ?”

কচুরীর থালা এগিয়ে দিতে দিতে মৃদু হেসে পিসঠাকুমা বললেন, “আমি কি একবারও বলেছি সেটা ?”

মেজো জা মধুশ্রী বললো, “ইস কি মজা হতো যদি দরজা খুঁজে পেয়ে যেতে পারতাম বলো ।” ওর বর আমার দেওর অর্ণব বললো, “ওঃ দারুণ হতো । তারপর এসে নাকে কাঁদতে, এঁই রে আমাঁর ব্যাঁগটা ফেঁলে এঁসেছি ওঁই জঁগতে, প্লিজ দঁরজাটা আরেঁকবার খুঁজে দাঁও না গোঁ ।”

মধুশ্রীর ভুলো মন বিখ্যাত । সবাই হাসতে লাগলাম । সঞ্জু বললো, “আচ্ছা, ওরকম একটা পৃথিবী থাকলে কেমন হতো সেটা তোমাদের মনে হয় ?”

“আর দরজাটা কি রকম – মানে গোল, না চৌকো, না কি মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়, কিংবা ধরো…”

সবাই কথা বলছে, আমি দেখলাম পিসঠাকুমা কিছু না বলে হাসিমুখে চেয়ে আছেন, কেমন যেন একটু অদ্ভুত লাগলো দৃষ্টিটা, একবার তাকালেন আমার দিকে, কি উজ্জ্বল চোখদুটি । মনে হলো কি যেন দেখে নিচ্ছেন আমার ভিতরে । অস্বস্তিতে মুখ নামিয়ে নিলাম ।

অনভ্যস্ত উঁচুনিচু পথে হাঁটতে ডান গোড়ালিটা একটু মচকেছিলো, পরের দিন দেখি বেশ ব্যথা । সেদিন আবার হাটবার এখানে, হরেক রকম স্হানীয় জিনিষ পাওয়া যায়, আমাদের সকলে মিলে যাবার কথা । আমি বললাম বাড়ি থাকবো, সবাই ঘুরে আসুক । দুপুরে দিব্যি পেট ভরে চিংড়ির মালাইকারি আর মাছের কালিয়া দিয়ে ভাত খাওয়ার পর ওরা বেরোলো, বড়ো ঠাকমা পান মুখে একটু ঘুমিয়ে নিতে গেলেন, তা না হলে নাকি ওঁর সন্ধ্যেবেলা কান কট কট করে । আর পিসঠাকুমা আমার দিকে চেয়ে বললেন, “আয় তো নতুন নাতবৌ তেতলায় আমার ঘরে, একটু গল্প করি তোর সঙ্গে । সাবধানে আয়, পায়ে না লাগে ।”

ওঁর দামী পুরোনো আসবাবে সাজানো বিরাট শোবার ঘরে বসে আমার কেমন বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো । উনি কারুকার্য্য করা বিশাল পালঙ্কে বালিশ ঠেস দিয়ে বসে আমার সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, “কালকের সিনেমা কেমন লাগলো তোর ?”

“ভালোই তো । সবার ভালো লেগেছে খুব ।”

“তুই বিশ্বাস করিস এসবে, না ?”

আমার গলা শুকিয়ে গেছিল, ঢোক গিলে বললাম, “না, মানে, থাকতেই পারে তো…”

পিসঠাকুমা আমার দিকে সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “আমি জানি তুই দেখিস, কি দেখিস বল তো ?”

“আ-আমি, আমি…”

“বল আমায় ।”

কিন্তু আমি যে এসব কথা কাউকেও বলিনি । সঞ্জুকেও না । বললে লোকে হয় আমায় পাগল ভাববে, কিংবা ভুল বুঝবে, কিংবা ভয় পাবে । প্রথম দিকে বলতাম, তারপর আর কাউকে বলিনি । আজ পিসঠাকুমার দিকে চেয়ে মনে  হলো এঁকে হয়তো বলা যায় ।

আমি যেগুলো সব দেখি সেগুলো সব দেখার কথা নয় । যেমন আমার কলেজের বন্ধু রুনির বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম, একটা ছোট্ট মেয়ে এঘর ওঘর ঘুরছে, পরে দেখি দেওয়ালে ওর ছবি, রুনির জন্মের আগে ওর এক বোন ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলো, ও বললো তার ছবি ওটা । আমার ঠাকুমার যখন খুব অসুখ গেছে কিন্তু অবস্হা একটু ভালোর দিকে, তখন এক দুপুরে দেখি উঠোনে চারজন লোক দাঁড়িয়ে, তাদের কোমরে গামছা জড়ানো, কাঁধে লাঠি, পিছনে একটা খাট নামানো । একটু পরেই মিলিয়ে গেলো, আর ঠাকুমা সেদিন সন্ধ্যেবেলা মারা গেলেন । একদিন জ্যোৎস্নারাতে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে যাচ্ছি, অবাক হয়ে দেখি একদল ছোট ছোট বাচ্চা হুটোপুটি করে বাগানে খেলছে, দাঁড়িয়ে পড়ে ওদের দিকে তাকাতে ওরাও মুখ ফেরালো, ওদের মুখগুলোতে কারো চোখ নেই, গর্তও না, চোখের জায়গাটা…একদম সমান… শুধু মসৃণ চামড়া । ভয়ে ছুটে ঘরে চলে গিয়েছিলাম ।

পিসঠাকুমা মন দিয়ে শুনছিলেন । আমি থামতে পারছিলাম না যেন । “…আমার পিসতুতো দিদির খুব বনেদী বাড়িতে বিয়ে হয়েছিলো । ওর গায়েহলুদে সবাই মজা করছি, খুব জাঁকজমকের তত্ত্ব এসেছে, ঝিচাকরেরা সব বারকোশ ট্রে নিয়ে এসেছে । একটা খুব লম্বা ঘোমটাদেওয়া দাসীর হাতে একটা বিশাল থালায় বড়ো বড়ো বাহারী সন্দেশ ।হঠাৎ শাড়ির নিচে তার তার পায়ের পাতার ওপর আমার নজর পড়লো, শিউরে উঠে দেখি, ওদুটো কোনো মানুষের পা নয়, কেমন চ্যাপটা, ধারালো নখ, কালো লোম…আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না, শুধু আমি…ওই মিষ্টিগুলো যারাই খেয়েছিলো তাদেরই খুব অসুখ করেছিলো । এইরকম, কতো, কতো…কেন আমি এগুলো দেখি ! দেখতে চাই না !”

আমি উঠে পড়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম । পিসঠাকুমা শান্ত গলায় বললেন, “শুধু এইসব ভয়ের জিনিস দেখিস ?”

“না, না, আরো কতরকম । আমার কাকীমার বাপের বাড়ি ভবানীপুরে, প্রায়ই বেড়াতে যাই ।একবার গিয়ে কোণের  ঘরের আলমারীর বই দেখছি, হঠাৎ দেখি পাশে একটা দরজা, আগে দেখি নি । কি মনে হলো, খুললাম, দেখি ধুধু মাঠ, বুনো ফুলে ছাওয়া, তার ওদিকে এক বিশাল নদী বইছে, ঝোড়ো ভিজে ভিজে হাওয়ায় ফুলগুলো উড়ে উড়ে আসছে । ভয় পেয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম । কাকীমা ঘরে ঢুকে বললেন চা খেতে আসতে, আমি পিছন ফিরে দেখি দরজাটা নেই, আর কাকীমা অবাক হয়ে বললেন, মেঝেতে এত ফুল এলো কি করে বল তো ! …একদিন শীতের শেষবাত্তিরে ঘুম ভেঙে দেখি, তখনো অন্ধকার কিন্তু পাশের একটা বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে । অবাক হয়ে উঠে এসে জানলাটা খুলতেই দেখি দিনের আলো, বাগানের গাছপালা নেই, একটা খুব সুন্দর চওড়া রাস্তা, আর একদল লোক কি অদ্ভুত পোশাক পরে শোভাযাত্রা করে যাচ্ছে, হাতে অচেনা সব বাজনা আর কতরকম পাত্র, ঘন্টা বাজছে, আর কি একটা ঘন সুগন্ধ…আমি পিছিয়ে এসে খাটে বসে পড়লাম, মনে পড়ে গেলো ওখানে কোনো জানলা টানলা কক্ষণো ছিলো না, আর অমনি সবটা ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল, পরদিন সকালে আমাদের সাবির মা ঝাঁট দিতে এসে বললো, দিদি ঘরে কি মিষ্টি গন্ধ, ধূপ জ্বেলেছিলে না কি…”

বলতে বলতে আমি কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, পিসঠাকুমা আমায় ধরে সোফায় বসিয়ে একগ্লাস জল ঢেলে দিলেন । আমি ওঁর মুখের দিকে চেয়ে বললাম, “তুমিও দেখো, তাই না ?”

উনি উত্তর না দিয়ে বললেন, “তুই কি ছোটবেলা থেকেই এই সব দেখিস ?”

“না না, ঐ যে আমার লকেটটা হারিয়ে গেলো, সেই থেকেই তো…”

পিসঠাকুমা দ্রুত বললেন, “লকেট ? কি রকম লকেট ? কি হয়েছিলো ?”

আমার জন্মের পর তিন চার মাস খুব ভুগেছিলাম, ডাক্তারেরা সারাতে পারছিলো না । বাঁচার আশাই ছিলো না নাকি । মা আমায় নিয়ে বাপের বাড়ি ছিলেন । মা’র ঠাকুমা তারপর আমায় একটা সোনার লকেট পরিয়ে দেন, বলেছিলেন কখনো যেন না খোলা হয় । আমি সেরে উঠি কিন্তু উনি তার কিছুদিন পরেই মারা যান, অনেক বয়েস হয়েছিলো ।”

“কি রকম দেখতে লকেটটা ?”

“ছোট গোল, বেশ ভারী । ডালাটা খুললে ভিতরে দুদিকেই কিসব খোদাই করা, মূর্তি, অক্ষর, ছক, বোঝা যায় না । বড় মা মানে মা’র ঠাকুমার বারণ ছিলো কাউকে খুলে দেখাতে ।”

“কি করে হারালো ?”

“আমাদের দেশের বাড়ি বর্ধমানে, বড়ো করে সরস্বতীপূজো হয় । আমার বয়েস তখন ষোলো সতেরো, বসন্তপঞ্চমীর দিন সকালে বাগানের দীঘিতে শখ করে স্নান করতে গিয়ে পড়ে গেলো, আর পাওয়া গেলো না । অনেক চেষ্টা করা হয়ে ছিলো । বিকেলে আমিও একলা একলা খুঁজছিলাম, জানো, আমি খুব ভালো সাঁতার জানি, কিন্তু সবাই বারণ করবে বলে চুপি চুপি গিয়ে ডুব দিচ্ছিলাম । জলের নিচে হাতড়াচ্ছিলাম, কেমন জেদ ধরে গিয়েছিলো…বিকেল পড়ে আসছে, ভাবছি এবার উঠে আসবো, এমন সময় কি যেন হাতে ঠেকলো, লকেট নয়…আমি তুলে এনে দেখি, একটা এক হাত মাপের মূর্তি…”

পিসঠাকু্মা শান্ত গলায় বললেন, “কালো পাথরের, মুখটা খুব লম্বা, হাত পা গুলো সরু গায়ের সঙ্গে জোড়া, বিরাট চোখে মণি নেই…তাই না ?”

আমি আমূল কেঁপে উঠে ওঁর দিকে তাকালাম । মুহূর্তে যেন অতীতে ফিরে গেলাম সেই সময়টাতে…কোমরজলে দাঁড়িয়ে আছি ভিজে কাপড়ে, চুল থেকে জল পড়ছে, হাতের মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে গা ছমছম করছে, বিকেল ফুরিয়ে ঘোর হয়ে আসছে, চারদিক চুপচাপ, হঠাৎ কেমন ভীষণ ভয় পেয়ে ওটাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রায় ছুটে বাড়ীর ভেতর পালিয়ে এসেছিলাম । রাতে প্রবল জ্বর এসেছিলো ।

বিমূঢ় ভাবে বললাম, “তুমি, তুমি কি করে জানলে ? জলে আবার ফেলে দিয়েছিলাম…”

পিসঠাকুমা সেকথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “এই বাড়িটাকে তোর কি রকম মনে হয় বল তো ?”

আবার কেমন আচ্ছন্ন লাগছিলো, তেমন কিছু না ভেবেই বললাম, “…এই বাড়িটা…এই বাড়িটা অনেক অনেক পুরোনো, আগে অন্যরকম ছিলো, আর তারও আগে এটা বাড়িই ছিলো না, অন্য কিছু ছিলো, সেটা, সেটা কি তা বলা না…আর এটা তো পাহাড়ের অনেক ভিতরে আর অনেক নিচে চলে গেছে, তাই না…তুমি জানো না ?”

“জানি ।এদিকে আয় তো ।” বলে আমার হাত ধরে সামনের জানলায় নিয়ে গেলেন, বললেন, “সামনের দিকে চট করে তাকিয়ে দেখ তো একবার, ওইপাশটাতে ।”

আমি দেখলাম, যেখানে রঙীন ফুলের ঝোপ আর দেবদারু গাছ ছিলো, সেখানটা ফাঁকা । বড়ো বড়ো পাথর আর মাঝখানে একটা পাথরের রুক্ষ এবড়োখেবড়ো বেদীমতো, রক্তে লাল, আর এপাশে ওপাশে ছিন্ন দেহাংশ … শিউরে উঠে চোখ ফিরিয়ে নিতেই আবার সব যে-কে-সেই । পিসঠাকুমা অদ্ভুত একটু হেসে বললেন, “আগে ওই জায়গাটা কি ছিল জানিস ? মশান । বধ্যভূমি ।”

আমি পড়ে যাচ্ছিলাম বোধহয়, পিসঠাকুমা সবল হাতে আমায় ধরে ফেলে বিছানায় এনে শুইয়ে দিলেন । “শান্ত হ’ নাতবৌ, আমি তোকে দেখেই বুঝেছিলাম, তাই তোকে একটু পরীক্ষা করে নিচ্ছিলাম, কতোটা দেখতে পাস ।”

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “আমি কিচ্ছু দেখতে চাই না, বুঝতে চাই না… কেন এমন হয় আমার ? সেই মূর্তিটাকে স্বপ্নে দেখি, ভয় করে, কাউকে বলতে পারি না, সঞ্জুকেও বলি নি ।”

পিসঠাকুমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আপনমনেই বললেন, “এই দৃষ্টিটা তোর স্বভাবেই, কিন্তু এটা ধারণের শক্তি তোর নেই…কবচটাও হারালি জলে, আর রাক্ষসী বেলায় একা একা ওকে জল থেকে নিজের হাতে তুললি…এমন তো হবারই কথা । আচ্ছা, আমি দেখি কি করা যায় । তুই ঘুমিয়ে পড় দেখি, শান্তিতে ঘুমো…।” ওঁর কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেলো আর আমি গভীর স্বপ্নহীন অতলে ডুবে গেলাম ।

ঘুম ভাঙলো যখন সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে ।সঞ্জু আর বড়োঠাকুমার উদ্বিগ্ন গলা, আর পিসঠাকুমা বলছেন, “আরে এতো চিন্তা করছিস কেন তোরা । একদম ঠিক আছে তো । দুপুরে আমরা গল্প করছিলাম, পায়ের ব্যথাটা বেড়েছিলো বেচারার, রাতে ঘুমোয় নি ভালো, আমি ওষুধ দিতে ঘুমিয়ে পড়লো ।”

আমিও উঠে বসে বললাম, “হ্যাঁ ঠিক আছি, ব্যথা কমে গেছে, দেখো ফোলাটাও প্রায় নেই ।”

কয়েকদিন কেটে গেলো বেশ স্বাভাবিকভাবেই, ভালোই লাগছিলো । বেশ হাল্কা লাগছিলো নিজেকে অনেকদিন পর । ফেরার ক’দিন আগে দুপুরে স্নান করে এসে দেখি, ঠাকুমা বলছেন, “খাবার সময় হয়ে গেলো, বড়ঠাকুজ্যি গেলো কোথায় ! সেই কখন থেকে দেখতে পাচ্চিনে । থেকে থেকে কোতায় যে উধাও হয় । চিরকালের অসংসারী বাপু, একা একা এমন জায়গায় পড়ে থাকে…বলি চোরডাকাতের ভয়ও কি নেই একটুও !”

রান্নার লোক মিনতিমাসী অমনি ফিক করে হেসে বললো, “চোরডাকাত-টাকাত সব তো কত্তামার ছোট্ট থেকে চেনা গো । ওরা সব মাঝে মাঝে আসে, কত্তামা খাওয়ান, খপর নেন, আপদে বেপদে সাহায্য করেন । এ বাড়ির ক্ষেতি করবে এমন সাহস কারো আচে নাকি !”

“ধন্যি বাপু ।” ঠাকুমা গালে হাত দিলেন । মিনতিমাসী বললো, “আমি ভাত বাড়চি, তোমরা বসো, উনি এখুনি এসে পড়বে’খন ।” রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো ।

মধুশ্রী বললো, “তখন দেখলাম যেন দোতলার পিছনের স্টোররুমগুলোর দিকে গেলেন ।”

আমি বললাম, “আচ্ছা আমি দেখে আসি ।” স্টোররুমগুলোর দিকে গেলাম, অনেকগুলো ঘর, পাহাড়ের ভিতরদিকে হবে বোধহয়, পাথরের দেওয়াল, অনেক অলি গলি, সত্যি যেন গোলকধাঁধা । আমি অনিশ্চিতভাবে পা বাড়িয়ে থেমে গেলাম । হঠাৎ আমার মনে হল, এই ঘর গলি সব পাহাড়ের ভেতরে কতোদূর…কতদূর বিস্তৃত হয়ে গেছে, কোনো শেষ নেই…কোথায় গেছে…সময়ের মাপ নেই ওখানে । মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো, রুক্ষ দেওয়ালটা ধরে সামলে নিলাম , আর তখুনি দেখি সামনের গলিটা দিয়ে পিসঠাকুমা এগিয়ে আসছেন ।

“ওমা তুই এখেনে ?”

“তোমাকে খুঁজতেই তো, অনেক বেলা হয়ে গেছে, সবাই খেতে ডাকছে ।”

উনি অপ্রতিভভাবে বললেন, “ওমা তাই, সময়…মানে সময়ের খেয়াল ছিলো না, দেরী হয়ে গেলো ।” একটু হাসলেন, “চল চল তাড়াতাড়ি । তোর জন্যেই একটা জিনিষ আনতে গিয়েছিলাম ।”

“আমায় আবার কি দেবে ! যেদিন এলাম কঙ্কণ দিলে তো । আর তোমার কাপড় চুল ভিজে কেন ?”

“ও কিছু না…তুই গিয়ে বল আমি এখুনি আসছি ।”

সেদিন খুব কুয়াশায় বাইরের সবকিছু ঢেকে গেলো । রাত্রে আমার কিছুতেই ঘুম আসছিলো । সঞ্জু গভীর ঘুমে ।উঠে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি শুধু ঘন কুয়াশা । কি মনে হলো, আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরোলাম । অনেক রাত্রি, বাড়ি নিঃঝুম । শুধু তিনতলায় পিসঠাকুমার ঘর থেকে যেন অস্পষ্ট চলাফেরার শব্দ পেলাম । সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম । খুব হাল্কা একটা আলো জ্বলছে । ঘরের লাগোয়া বারান্দার দরজাটা খোলা, বারান্দা থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি সামনের জমিটা অবধি । আর…আর, বাইরের সবটা স্বচ্ছ জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করছে ।কোথাও কুয়াশার চিহ্ন নেই । সবটা অন্যরকম, ঘরবাড়ি কিচ্ছু নেই, উঁচুনিচু জমি, একটা নদী চিকমিক করছে, গাছপালা হাওয়ায় দুলছে, দূরে পাহাড়ের চূড়োয় বরফ, কি একটা ফুলের সুগন্ধ… কয়েকটা বড়ো পাখি জ্যোৎস্নার মধ্যে দিয়ে  উড়ছে, ওদের পাখায় নীল বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে । দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে পিসঠাকুমা উঠে আসছেন বারান্দায়, মুহূর্তের জন্য মনে হল উনি বৃদ্ধা নন, যেন ষোলো বছরের রূপসী তরুণী, তারপর ঘরের মধ্যে এলেন, আগের মতোই, যেমন ছিলেন । আমি বারান্দায় যাবো বলে সম্মোহিতের মতো পা বাড়িয়েছিলাম, উনি আমায় ধরে ফেললেন ।

“কোথায় যাচ্ছিস, নাতবৌ ?”

“ওইখানে, বাইরে, কি সুন্দর দেখো, স্ফটিকের মতো…”

“যাস না, নাতবৌ । ওই জ্যোৎস্না যার গায়ে পড়ে তার আর সংসার করা হয় না । ওই জ্যোৎস্না পাখিদের ডানার হাওয়া এসে বুকে লাগলে আর ঘরকন্নায় মন দেওয়া যায় না । আমারও হয় নি, আমিও তাই চেয়েছিলাম । কিন্তু তুই তো সংসার চাস, স্বাভাবিক জীবন চাস, তাই না ।”

“হ্যাঁ, পিসঠাকুমা, কিন্তু…”

“তোর এই দৃষ্টিটা আছে, কিন্তু তুই অনেক কিছু দেখিস তাতে ভয় পাস, সহ্য করতে পারিস না । অনেক অপরূপ, কল্পনাতীত আশ্চর্য কিছু আছে, তার জন্যে ওই ভয়ের অভিজ্ঞতাও সইতে হয়, তুই পারবি কি ? সময় হয় নি তোর ।”

“না না পারবো না…”

“এই নে এটা । আর হারাস না । সঙ্গে রাখিস সারাক্ষণ ।”

আমার হাতে দিলেন সেই লকেটটা । আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, “তুমি, তুমি এটা কোথায় পেলে ?”

“তুই যেখানে হারিয়েছিলি, সেইখান, সেই সময় থেকে তুলে আনলাম । না, আর প্রশ্ন করিস না । শোন নাতবৌ, এটা যদি আবার হারাস, সঙ্গে না রাখিস, আবার সেই দৃষ্টি ফিরে আসবে, সংসারে তোকে থাকতে দেবে না । অনেক কিছু পাবি, আবার অনেক কিছু হারাবি ।”

বাইরের জ্যোৎস্না মিলিয়ে গেলো । পিসঠাকুমা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, “যা, নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে পড় ।”

ক’দিন পরে ফিরে এলাম । আর পিসঠাকুমার সঙ্গে দেখা হয় নি । এর কিছুদিন পরে উনি মারা যান । বাড়িটা বোধহয় বন্ধই পড়ে ছিলো, যতদূর জানি কেউ থাকে না ওখানে । আমি আমার সংসার, সন্তান, কাজ, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আছি, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম । শুধু গলার সরু হারের লকেটটার দিকে চেয়ে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাই ।

সমাপ্ত

( কপিরাইট সংরক্ষিত )   

 

Profile Tandra Banerjee

তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখক পরিচিতির জন্য এখানে ক্লিক করুন

error: Content is protected !!