sukh

১ ।

শঙ্কর কর্মকারের ঘরে পাবে নাএমন নেশাদ্রব্য নেই। সিগারেট, মদ গাঁজা তো পাবেই, চরস, হেরোইন, এল এস ডি, এক্সটাসি, ইত্যাদি কত নিষিদ্ধ আর ততটা নিষিদ্ধ নয় এমন পার্টি ড্রাগ ওর ঘরে আছে ভাবতে পারবে না।

কি ভাবছো? শঙ্কর নেশাখোর?দৈনিক তিনকাপ মকাইবাড়ি চা খাওয়াকে যদি নেশা বলো, তবে তাই। তাছাড়া ওর অন্য বদভ্যাস নেই। ড্রাগ ডিলার? আরে না না, যেটুকু পরিমানে ওই দ্রব্যগুলো আছে, তাতে নেশা হবে, ব্যবসা হবেনা।

যদি বলি ডাঃ শঙ্কর কর্মকার, পি এইচ ডি’র পরে যার বাইশখানা  রিসার্চ পেপার আর ন’খানা পেটেন্ট আছে, ফার্মাসিউটিকালসে যাকে সত্যজিতপ্রেমীরা ‘প্রফেসর শঙ্কু’ বলে ডেকে থাকেন, এবং বর্তমানে যিনি ‘শঙ্কু’স ল্যাব’ নামক আধুনিকতম ওষুধ গবেষণাগারের মালিক, ইনিই তিনি? চমকে গেলে তো! আসলে গত কয়েক বছর ধরে এই নেশাদ্রব্যই শঙ্করের ধ্যানজ্ঞান।


একটু খুলেই বলি। কোনো নেশাদ্রব্যে নেশা হয় কেন?


দেখা গেছে নিউক্লিয়াস অ্যাকুমবেন্স বলে মগজের এক খটমট প্রদেশে ডোপামিনের বন্যা বইয়ে দিয়ে নেশা মানুষকে তৃপ্তি দেয়। আর নেশা ছাড়া বাকি যে সময় আমরা খুব খুশি হই, ধরো ভালো বই বা সিনেমা দেখার যে সুখ, সেটা আসে  প্রিকুনিয়াস বলে মগজের একটা অঞ্চলে। শঙ্কর এই দুটো অঞ্চলের একটা সেতু বানানোর উপায় খুঁজছে। মানে এমন একটা ওষুধ, যা মগজের এই দুটো অঞ্চলকে উদ্বুদ্ধ করে মানুষকে সুখ খুঁজে দেবে। তার সাথে শঙ্কর একটা ছোট্ট চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে। সেই ওষুধটার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে না।


ধূমপায়ীরা ধূমপান করে যে সুখ পান, মাতালরা মত্ত হয়ে যে আবেশে পৌঁছান, হেরোয়িনে ‘হাই’ বা গাঁজার ‘ধুমকি’ যে অপার্থিব রাগমোচন করে মগজ জুড়ে, সেই অনুভূতিটা যদি ওই সব ড্রাগের ক্ষতিকারক দিক ছাড়া পাওয়া যায়, তবে মনোবিজ্ঞানের জগতে একটা দিগন্ত খুলে যাবে। পাঁচবছর পরে শঙ্কর অবশেষে তার গবেষণার প্রায় শেষে এসে পৌঁছেছে।


কমপাউন্ড নাম্বার ১০৯১, এখন অবধি মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে কোনো সাইড এফেক্ট দেয়নি। কিন্তু ল্যাবরেটারির ইঁদুর বা বাঁদরের তো কোনো ডিপ্রেশন বা নেশাদ্রব্য নেওয়ার অভ্যেসে নেই। কাজেই সাইডএফেক্টলেস ওষুধের এফেক্ট কতটা কার্যকারী , তা নিয়ে শঙ্কর যথেষ্ট সন্দিহান।


কিন্তু সেই অনুমতি পাওয়া একটা দুরূহ ব্যাপার। প্রতিটি প্রয়োগের নথি থাকতে হবে, ইনফর্মড কনসেন্ট, নিউট্রাল অবসার্ভার, ডারল ব্লাইন্ড স্টাডি ইত্যাদি নানা খটোমটো ব্যাপার পেরিয়ে উৎপাদনে অনুমতি পেতে হলে পাক্কা পাঁচ সাত বছর। তোমরা যারা যেকোনো আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওষুধ ব্যবহার করছো, জেনে রাখো, সব ওষুধকে ওই স্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শঙ্করের কমপাউন্ড ১০৯১ তারই প্রথম ধাপে এসে পৌঁছেছে। এখন পাঁচ সাতবছর অনন্ত অপেক্ষা।

                         

 

২ ।


Dear Dr Karmakar, we feel your molecule is yet not ready for human trial regarding effects, effectivity and side effects. Kindly go through the following procedural lists and complete them before applying again.

চিঠিটা আর পড়লেন না শঙ্কর। উনি জানেন ওতে কি লেখা আছে , এমনি এমনি নখানা পেটেন্ট তো পাননি। এডওয়ার্ড জেনারের সময় গেছে, যখন গোবসন্ত’র জীবাণু স্রেফ পর্যবেক্ষণের অনুমানে গুটিবসন্তের টিকা হিসাবে দেওয়া যেতো। যদিও মানুষের সংখ্যা এখন বেশ কয়েকগুণ, তবু মানুষ এখন আর গিনিপিগ হতে চায় না। আরো বেশ কিছু পরীক্ষা চালাতে হবে ওঁকে। কিন্তু, নেশা করা প্রাণী কোথায় পাবেন। নাহয় সেটাও পেলেন, তাদের মগজে কি ডোপামিন একই ভাবে কাজ করবে? তাদেরও কি প্রিকুনিয়াস আর নিউক্লিয়াস অ্যাকুম্বেন্স আছে? এই সাধারন তফাতটা কে বোঝাবে ওপরওয়ালাদের?

তার সাথে আরেকটা দুর্ভাবনাও মনে উঁকি দিলো। সত্যি যদি কিছু হয়, যেভাবে তিনি মগজে ডোপামিন যাবে ভাবছেন, তেমন যদি না যায়? যদিও অজস্র কম্পিউটার সিমুলেশন এবং অ্যানিমাল এক্সপেরিমেন্টস বলছে কমপাউন্ড ১০৯১ সম্পূর্ণ নিরাপদ, তবু ইতিহাস সাক্ষী, বহু বিরূপ ক্রিয়া আগে থেকে আন্দাজ করা যায় নি। চিন্তিত মুখে শঙ্কর আবার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে ডুবে গেলেন কাজে। দুর্ভাবনা থেকে বাঁচতে ওটাই সহজ উপায়।


আরো ছয়মাস। শঙ্কর নিশ্চিত এবং সর্বতোভাবে তৈরি।কিন্তু তিনি জানেন, অনুমতি পাওয়া যাবেনা এত জলদি, সম্ভবত কখনোই। সফল হলে বাজার চলতি যাবতীয় নেশাদ্রব্য এক লহমায় বাতিল হয়ে যাবে,  বহু অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ভোকাট্টা হয়ে যাবে। ক্ষতির পরিমান কত বিলিয়ন ডলার, শঙ্কর আন্দাজ করতে পারেন। অন্যভাবে এগোতে হবে। অন্যভাবে…ভাবতে ভাবতে শঙ্করের মাথায় একটা প্ল্যান খেলে যায়।


৩।


বার দশেক তদ্বির তদারক করে শঙ্কর বুঝলেন, কোনোভাবেই কমপাউন্ড ১০১৯ বাজারে আসবে না। মাফিয়া থেকে সরকার, ব্যবসায়ী থেকে ছোটো দোকানদার, সকলের মিলিত ক্ষতির কাছে মানবজাতির কল্যাণ নিতান্ত তুচ্ছ। কিন্তু তিনি বৈজ্ঞানিক, এত বড় আবিষ্কার নষ্ট হতে দেবেননা কিছুতেই।

তাই একদিন, বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে শঙ্কর কয়েকদিনের জন্য হাজির দাদামনির’ আশ্রমে।

দাদামনি, ওরফে ভোলানাথ সর্দার, ওরফে ভ্যাবলা, শঙ্করের সাথে দশক্লাস অবধি পড়েছে। তারপর সে ফেল করে রয়ে গেলো, আর শঙ্কু তরতর করে এগিয়ে গেলো আকাশের দিকে, কিন্তু প্রবল অসাম্যের বড়বেলা দুজনের ছোটোবেলাতে কোনো চিড় ধরাতে পারেনি। কোথায় এক গুরু ধরে গেরুয়া নিয়ে ভোলা এখন দাদামনি নাম নিয়েছে, রুদ্রাক্ষ আর জটা সহযোগে এখন তাকে দেখলেই একটা ভক্তিভাব জাগে।

তবে  ক্ষতিকারক বাবা হয়নি সে, একটা ছোটোখাটো আশ্রম চালায় । সেখানে রীতিমতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনেই ড্রাগ আর মদের নেশাড়ুদের চিকিৎসা করা হয়।


এই খানে একটা মাল্টিপল ডিফল্টারদের লিস্ট আছে। যারা বারবার নেশা থেকে বেরোতে গিয়েও পারেনি, আবার সেই চোরাবালির আবর্তে ফিরে গেছে। অনেকেরই মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা। লিস্ট বের করে ভ্যাবলাকে বললেন, এদের ডাক, বাবা মা সহ। দাদমণির ডাক অমান্য করেননা ভক্তরা, কদিনেক মধ্যেই সাতটি ছেলে, তিনটি মেয়ে তাদের বাবা মা সহ হাজির। সকলেরই বয়েস কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে। কিছু চেহারা আর নেশাকে লুকাতে পারেনা, এদের প্রত্যেকেই তাই।


শঙ্কর শুরু করলেন বাবা মা’দের দিয়ে ‘ আপনাদের প্রত্যেকের সন্তানই মৃত্যুর মুখে। আমি একটি ওষুধ বের করেছি যা দিয়ে হয়তো নেশা ছাড়ানো সম্ভব। কিন্তু লাল ফিতেতে আটকে গেছি। এখনো অবধি অন্য প্রাণীতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাইনি, কিন্তু মানুষের ওপর কি হবে সেটা অনিশ্চিত। অবশ্য একটা অ্যান্টিডোট তৈরি করেছি, কিন্তু সেটাও টেস্ট করা নেই। আপনারা চাইলে আমি প্রয়োগ করতে পারি এই ওষুধ।’

এ হেন অনিশ্চয়তায় প্রায় কেউই রাজি হলেন না। শুধু দুজন, সৌরভ আর আত্রেয়ী’র বাবা মা বললেন ওদের সাথে কথা বলে জানাবেন। হতাশ শঙ্কর দাদামণির সাথে চা খাচ্ছেন, হঠাৎ দরজার বাইরে টোকা। সৌরভ। বছর পঁচিশেকের হাড় পাঁজর বের করা চেহারা। এককালের মেধাবী ছাত্র ,বার তিনেক ব্যর্থ আত্মহত্যার চেষ্টা করা সৌরভ। যে হেরোয়িন ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারেনা। রিল্যাপস করেছে ন’বার।


দাদামনি , আমায় ওষুধটা দিন। এমনিতেও আর কটা দিনই বা আছি। টানতে পারছি না আর। মা বাবাইকে দেখলে আরও কষ্ট হচ্ছে।


অজস্র সই সাবুদের পরে চালু হলো ওষুধ। স্বাদহীন, গন্ধহীন কম্পাউন্ড ১০১৯ দুধে দিয়ে খেতে দিলেন শঙ্কর সকাল আটটায়। তারপর, শুধু মনিটরিং আর অপেক্ষা।


সারা দিন, সারা রাত।


কতকিছু বাড়াতে কমাতে হচ্ছে শঙ্করকে! কতটা দিতে হবে, কতক্ষণ অন্তর সব কিছুই যে অজানা। তবে দেওয়াটা অসুবিধা নেই, দুধ জলের সাথে গুলে যাচ্ছে। মোটামুটি একটা ধারণা থাকায় কয়েকদিনের মধ্যেই শঙ্কর  ঠিক করে ফেললেন এমন ডোজ, যা চব্বিশ ঘন্টা অন্তর একবার দিলেই হবে। একটা ক্যাপস্যুল প্রিপারেশন করলেন তারপর, যাতে স্লো রিলিজ হয়ে সাতদিন দেবে ওই ডোজ। মানে সপ্তাহে একবার।


দাদামণির এই ব্যাপারে খুব উৎসাহ। শঙ্করকে সে প্রায় সত্যি ভগবান শিবের মতো দেখে, যদিও নিজের গেরুয়া আর জটার জন্য তার নিজের ভক্তকুলও কম না। দেখতে দেখতে তিনমাস। সৌরভ তিনমাস ড্রাগস ছোঁয় নি। সৌরভ গত একমাস সপ্তাহে একবার ওষুধ খায়। ও বলে, এ এক অদ্ভুত তৃপ্তির জগৎ, যেখানে বসে পড়াশোনা করা খুব সহজ হয়ৈ গেছে। আর সৌরভকে দেখে, প্রথমে আত্রেয়ী, তারপর রফিক, গুরপ্রীত, শ্যামল, ডোনা, সুকান্ত.. লিস্টটা বেড়েই চললো। এক বছরের মধ্যে সংখ্যা একশো ছুঁয়েছে। দাদামণির আশ্রমের খবর চাউর হয়ে গেছে। শঙ্করকে এখন আর সবাইকে দেখতে হয় না, তার বন্ধু ভ্যাবলাই  সব দেখার ভার নিয়েছে। পাশেই একটা বন্ধ স্কুল নিয়ে বাড়িয়ে ফেলেছে তার আশ্রম। শঙ্কর সফল। কিন্তু পেটেন্ট নিতে পারছেন না যে! এভাবে ওষুধের প্রয়োগ তো অবৈধ।


বাধ্য হয়ে ড্রাগ কন্ট্রোলার দপ্তরে লিখে জানালেন শঙ্কর। সাথে সব রোগীর অনুমতিপত্র
, ভিডিও কনসেন্ট। সাফল্যের হার একশো শতাংশ, সাইড এফেক্ট শূন্য। মনে মনে একটা নামও দিয়েছেন শঙ্কর ওষুধটার। ‘ সুখ’।

৩।


প্রত্যাশিত ভাবেই ড্রাগ কন্ট্রোল নানান ঝঞ্ঝাটের পরে এক মাল্টিসেন্ট্রিক ট্রায়াল চাইলো। আরো বহু সেন্টারে ওষুধের পরীক্ষা হবে, প্লাসিবো ও আসল ওষুধের সাথে। প্লাসিবো জানো তো? ওষুধ থাকেনা এতে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে অবিকল আসল ওষুধের মতো। শঙ্কু’স ল্যাব শুধু ওষুধ সরবরাহ করবে, কিন্তু প্রয়োগের সাথে কোনোভাবেই যুক্ত থাকবে না। এই ব্যাপারটাকে ডাবল ব্লাইন্ড ট্রায়াল বলে।

কোনো ওষুধের গুণাগুণ পরীক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ।


আরো এক বছর। সর্বত্র ফলাফল এক। দলে দলে ড্রাগ রোগীরা মুক্ত হচ্ছে। শঙ্করের গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরে, সারা পৃথিবীর প্রায় সব হোমরাচোমরা কোম্পানি বহু কোটি ডলারের প্রস্তাব দিতে থাকলো।শঙ্কর যথেষ্ট অর্থবান। তার ওপরে এই ওষুধে লাভের ইচ্ছে বিশেষ নেই। সুতরাং শুধু শঙ্কু’স ল্যাবই প্রস্তুত করতে থাকলো ‘সুখ’।

নোবেল প্রাইজ এবার সময়ের অপেক্ষা শুধু।

একদিন রাত আড়াইটেয়, একটা ফোন এলো শঙ্করের কাছে। এক এশিয়ার দেশের অ্যাম্বাসাডার দেখা করতে চান এই দূত শঙ্করের পূর্বপরিচিত, বস্তুত আমলা হওয়ার আগে বায়োটেকনোলজিস্ট হিসেবে যথেষ্ট নাম ছিলো তাঁর। সেই সূত্রেই নানা অধিবেশনে দেখা হতো। তিনি দেখা করতে চান ঘন্টার মধ্যে। ব্যাপারটা জরুরি। কি এমন জরুরি যে সকাল অবধি অপেক্ষা করা যাবেনা? ওই দেশের প্রধানকে বিলক্ষণ চেনেন শঙ্কর। বিরোধীকে উধাও করে দিতে তাঁর হাত কাঁপে না।অজস্র আন্দোলনকারীর  রক্ত তাঁর হাতে। সেই দেশের রাষ্ট্রদূত। কেন? এসব চিন্তার মধ্যে রাষ্ট্রদূত জানালেন, তিনি শঙ্করের বাড়ির গেটে। সিকিউরিটিকে ডেকে সব ক্যামেরা ঠিক আছে কিনা দেখে, শঙ্কর স্বাগত জানালেন তাঁকে। রাষ্ট্রদূত, সাথে আর এক ভদ্রলোক। সানগ্লাস, ফ্রেঞ্চকাট আর বাবরি । কে ইনি? রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘ আগে ক্যামেরা অফ হোক প্রফেসর। সিকিউরিটি চেক করেছে , আমরা নিরস্ত্র। গেট বন্ধ। আপনি পাঁচ মিনিটের জন্য ক্যামেরা অফ করুন। নির্দেশ দিয়ে দিন, পাঁচ মিনিটে আপনার তরফে কোনো বিপদ বুঝলে শুধু হাঁক দিলে যেন আমাদের ঝাঁঝরা করে দেয়। মনে মনে সাবধান হলেন  শঙ্কর। সিক্যুরিটি প্রধান রমাপ্রসাদকে যা বোঝার বুঝিয়ে অফ করালেন ক্যামেরা। প্রখর ধীতে তিনি বুঝেছেন অন্য লোকটি কে।


রাষ্ট্রপ্রধান। সব কুটনৈতিক ফিতে এড়িয়ে তাঁর বাড়িতে আজ এশিয়ার সবচেয়ে স্বৈরাচারী শাসকটি দাঁড়িয়ে আছেন নতমস্তকে। তাঁর মেয়ে এক অসম্ভব অন্ধকারের রাস্তায়। ড্রাগ অ্যাডিক্ট বহু বছরের, হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না। অথচ শঙ্করের ওষুধ ও দেশে পৌঁছতে লাল ফিতের ফাঁস ডিঙোতে লাগবে অনির্দিষ্টকাল, কারণ কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও, দুটো দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। কিছু ওষুধ যদি শঙ্কর দেন, প্রাণরক্ষা হয়ে বাপের চোখের মণির।না করতে পারলেন না শঙ্কর।  একবছরের মতো ওষুধ দিয়ে দিলেন। রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো রাষ্ট্রদূতের গাড়ি।


দিন চলে যায়। মাস ছয়েক পরে রাষ্ট্রদূত আরেকবার এসে দাঁড়ালেন শঙ্করের বসার ঘরে। উপহার হিসেবে এক অসীমমূল্য হীরের আংটি। শঙ্কর ফিরিয়ে দিলেন। দূত অবাক হলেননা, শঙ্করকে তিনি চেনেন। আর একটা কথা বলতে এসেছেন তিনি। সিঙ্গাপুরে একটা বহুরাষ্ট্রীয় সমাবেশে প্রধান আসছেন। সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে শঙ্করের আমন্ত্রণ আছে। প্রধান একবার নৈশভোজে ডেকেছেন তাঁকে। সাথে দয়া করে যেন একবছরের ওষুধ আবার নিয়ে যান শঙ্কর। নিমরাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না শঙ্করের।

৪।

 

সিঙ্গাপুর। শঙ্করের বক্তৃতায় তিলধারণের জায়গা নেই। আগামীর নোবেলজয়ীর বক্তৃতা সবাই শুনতে চায়। অবশেষে এক ড্রাগমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন সাকার হবে। শঙ্করকে সিঙ্গাপুর সরকার স্পেশাল কমান্ডো নিরাপত্তা দিয়েছেন। মাফিয়াদের বিশাল সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে। সুতরাং, সাবধানের মার নেই।

তবে নৈশভোজের সময়, শঙ্কর একাই ঢুকলেন দূতাবাসে। সাথে এক বছরের ওষুধ।


রাষ্ট্রপ্রধান জড়িয়ে ধরলেন শঙ্করকে। তিনি ছাড়া বাকি সবাই প্রধানের খাস লোক। ইংরাজি বোঝেননা বেশির ভাগ। বোঝা গেলো প্রধান মদ্যপানেও বেশ রসিক। ঝপাঝপ পাঁচ পেগ। শঙ্কর খাননা। তাতে আওয়াজ দিতে ছাড়লেন না প্রধান। তারপর আহ্বান জানালেন একটু নিভৃত আলাপের। চা বনাম ছ’নম্বর পেগে অসম আড্ডা।


প্রফেসার, কোনো সাধারণ লোককে আপনার ওষুধটা দিলে কি হবে?’ মাতাল প্রধানের প্রশ্ন।

সাধারণ মানে?’


যাদের নেশা নেই, আপনার মতো’


জানি না। প্রয়োগ তো করিনি কখনো।

আমি বলছি। হো হো করে হেসে উঠলেন প্রধান। আমরা আপনার ফর্মুলাটা আবিষ্কার করতে পারিনি, মানে তৈরী করতে পারিনি এখনো। কিন্তু ক্লোন করতে পেরেছি, মানে তৈরি জিনিসটি নকল করতে সক্ষম হয়েছি।এর কন্ট্রোলটা রেখেছি স্বয়ং আমার হাতে,  আর আমরা প্রয়োগ করেছি সাধারণ মানুষের ওপর। ফল কি হয়েছে জানেন?

কি? বৈজ্ঞানিকের অনুসন্ধিৎসা জেগে ওঠে।


ওরা যে যেখানে যেমন অবস্থায় আছে, তাতে সুখী হয়ে গেছে। আধপেটা খেয়ে, অশিক্ষাতে, অসুখে মরে ওরা সবাই সুখী! এমনকি জানেন, আমার কারাগারের বন্দীগুলোকে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেওয়ার পরেও, ব্যথায় কঁকাতে কঁকাতে ওরা বলে এই কারাগারের জীবনটাতে ওরা ভালো আছে। আমি জানি আপনি ফর্মূলাটা দেবেন না। কিন্তু ক্লোন করা থামাবেন কি করে প্রফেসর?’

হো হো করে হেসে প্রধান হাত বাড়ালেন বোতলের দিকে। কেউ ছিলো না, অগত্যা শঙ্কর ঢেলে দিলেন সাত নম্বর পেগ অনভ্যস্ত হাতে।

এই তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া!  সাধারণ লোকের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগে তারা যেমন জীবনযাপন করছে , তাতে সুখী হয়ে যাবে। কোনো বিদ্রোহ নেই, দাবীদাওয়া নেই দুনিয়ার সব রাষ্ট্রনায়ক, উন্মাদ ধর্মপাগলদের অব্যর্থ অস্ত্র হবে ‘সুখ’।

আরো কিছুদিন গবেষণা করে এর বিহিত করে তবেই আবার এই ওষুধ বাজারে দেবেন শঙ্কর। ভাগ্যিস এই রাষ্ট্রটির সাথে কারো সদ্ভাব নেই। ঘড়ঘড় নাক ডাকছেন রাষ্ট্রপ্রধান। শঙ্কর তাঁর সহযোগীকে ডেকে সাবধানে বেরিয়ে এলেন।

  ৫।


পরদিন শঙ্করের ঘুম ভাঙলো প্রবল হট্টগোলে। অনেকে একসাথে কথা বললে যেমন হয়। বেরিয়ে দেখলেন
, হোটেলের হলঘরে যে বিশাল টিভি , তার সামনে জনতার ভিড়। আর স্ক্রিন জুড়ে ছবি দেখা যাচ্ছে তাঁর গত রাত্রির আপ্যায়নকারীর। রাষ্ট্রপ্রধান। কি বলছেন তিনি?

গভীর দুঃখের সাথে তিনি জানাচ্ছেন যে তিনি এতাবত অত্যাচারী এবং অসংখ্য মানবতাবিরোধী কাজ করেছেন।

তার খতিয়ান দিয়ে তিনি পদত্যাগ করে নিজেকে তুলে দিতে চান ইন্টারপোলের হাতে, আর দেশে চান গণতান্ত্রিক নির্বাচন। সকলে স্তম্ভিত হয়ে এই অলৌকিক কিভাবে সম্ভব হচ্ছে বুঝতে পারছে না, কাজেই হলঘরে কোলাহল।

মৃদু হাসলেন শঙ্কর। কম্পাউন্ড ১০১৯, যা সুখের অ্যান্টিডোট হিসেবে তৈরী করেছিলেন সবসময় নিজের কাছে রাখেন তিনি। কারণ , ওষুধটা ঠিক সুখের বিপরীতে গিয়ে সব ডোপামিন শুষে প্রচন্ড আত্মগ্লানির জন্ম দিতে সক্ষম। তার থেকেও মুশকিল, প্রভাবটি আজীবন স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং ভুল হাতে পড়লে সর্বনাশ।


সাত নম্বর পেগে সেটাই মিশিয়ে দিয়েছিলেন শঙ্কর।


সমাপ্ত

error: Content is protected !!