Bodhis

প্রথম পর্ব  

এই কিছুদিন আগের কথা, একটা পাগল গড়িয়াহাটের মোড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যে ট্র্যাফিক পুলিশদের সঙ্গে সঙ্গে ট্র্যাফিক সামলানো সামলানো খেলা খেলত। উস্কখুস্ক চুল, জটা হয়ে যাওয়া দাড়ি গোঁফ, গায়ে তেলচিটে জামা, শত ছিন্ন একটা প্যান্ট, কোমরে নাইলনের এক টুকরো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা একটা মাটির ভাঁড় , গলায় ফেলে দেওয়া শুকনো গাঁদাফুলের মালা, ওর মা এলেও বোধহয় ওকে চিনে উঠতে পারতেন না। পুলিশ, লোকজন, আশপাশের দোকানদারেরা হাজার গালিগালাজ করলেও ওকে ওই ভুলভাল ট্র্যাফিক সামলানো থেকে আটকে রাখা যেত না । মনে হত ওটাই ওর আসল পাগলামো। সবাই বলত আগের জন্মে ও বোধহয় অ্যাকসিডেন্টে গত হয়ে যাওয়া কোন ট্র্যাফিক সার্জেন্ট ছিল। ধীরে ধীরে কোন এক অদ্ভুত কারনে শেষমেশ ওর এই ডিউটি সবাই বেশ কেমন মেনেও নিল। পথ চলতি মানুষ থেকে পুলিশ, দোকানদার সবাইকে ও কেমন যেন একটা স্নেহের বাঁধনে বেঁধে ফেলল। লোকে ওকে ভালবাসতে শুরু করল। সকালবেলা চূড়ান্ত ব্যস্ত অফিস টাইমের মধ্যেও অনেকে শুধু একটা হাসি মজা করা দিলখুশ পাগল দেখবে বলে গড়িয়াহাটের মোড় দিয়ে যাতায়াত করা শুরু করে দিল।  পাগল হয়ে উঠল বাচ্চাদের খুব প্রিয়। বা বড়দেরও। কেউ হয়ত গাড়ির কাঁচ নামিয়ে কখন একটা সিগারেট দিল বা পথ চলতি কেউ একটা বিড়ি। ও সিগারেট দিলে থ্যাঙ্ক ইউ আর বিড়ি দিলে নিয়ম করে ধন্যবাদ বলতেও জানত। ঘর্মাক্ত কলেবরে ছায়ায় এসে দাঁড়ালে হয়ত কারো বদান্যতায় জুটে যেত দু এক ভাঁড় চা। ট্র্যাফিক সার্জেন্ট’রাও ওকে ভালবাসতে শুরু করল। ওরাই রাস্তার আর ফুটপাথের সব খাবার দোকানদারদের ধমকে বলে দিল পাগল যেন সকালে কচুরি আর দুপুরে পাইস হোটেলে ভাত তরকারি খেতে পারে।

অনেক রাত হয়ে গেলে পুলিশদাদারা যখন ওদের ওই গুমটির পেছনে লুকিয়ে চুরিয়ে মদ খেত তখন বোতলে দু ইঞ্চি মদ বাকি থাকতে ওকেও হয়ত ডাকত , জিজ্ঞেস করত, “এই পাগলা, এই সালা মাল খাবি?” পাগলা বুঝদারের মতো জিজ্ঞেস করত, “কি মাল?” পানের ছোপ লাগা দাঁত বার করে ঈষৎ ঢুলু ঢুলু চোখে হকদা, ট্র্যাফিক পোস্টের বড়বাবু, কোমরের বেল্টের অশোক চক্রটা আল্গা করে দিতে দিতে হেসে বলতেন, “এই সালা, মালের আবার কি? মাল, মাল।“ পাগল লাজুক হেসে মাটির দিকে তাকিয়ে জবাব দিত, “না স্যার হুইস্কি না হলে আমি খাই না”। বারবার এই একই প্রশ্নের একই জবাব শুনে পুলিশ দাদারা হেসে কুটিপাটি হত ।  তাতে যেন আরও জমে উঠত মৌতাত আর পাগল ও এমন একটা বোদ্ধা বোদ্ধা ভাব করত দেখে যেন মনে হত সে অন্তত বিনে খাটনিতে মদটা খায় না, উপার্জন করেই খায়। দু ঢোক খাওয়ার পর পাগল নানারকম গল্প বলত, কিছু বোঝা যেত, কিছু থেকে যেত দুর্বোধ্য পাগলামোতে ভরা হকদা জিজ্ঞেস করতেন, “এই সালা তুই পাগল হলি কি করে রে?” পাগল অবাক হয়ে তাকিয়ে বলত, “ বাঃরে, আমি পাগল হতে যাব কোন দুঃখে? পাগল তো আপনারা। আমার কথা হাঁ করে শোনেন আর নিজেদের পয়সায় আমায় মদ খাওয়ান”। মধ্যরাতের পথ চলতি দু একটা গাড়ী যখন পুলিশদের এই হাসির হররা দেখত তখন মনে মনে খিস্তি করত আর ভাবত সালারা আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় মাইনে পাচ্ছে ঘুষের টাকায় মদ খাওয়ার জন্য।  অলোক পাত্র, মেজবাবু, যিনি ওদের মধ্যে সব থেকে সুপুরুষ এবং সবথেকে কম মদ খান, তিনি বলে উঠতেন, “ওরে আমার বাঞ্ছারাম; হক’দা, এ মাল জাতে মাতাল তালে ঠিক; চলুন কাল এটাকে ভ্যাগাবন্ড সেন্টারে চালান করে দি”  

তারপর একে একে সার্জেন্টদের বুলেটগুলো মিলিয়ে যেত সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোর বৃত্তের বাইরে, পাগল একা দাঁড়িয়ে দেখত। তারপর রাত আরও অনেক গভীর হলে কোথা থেকে লুকিয়ে রাখা চাট্টি ভাত আর ঘ্যাঁট খেয়ে একটা ছেড়া চট পেতে পাগল সে শুত আনন্দমেলার সামনে, যার শো কেসে একদম ছোট একটা জামা পরে একটা ফ্রিজের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকা কার্ডবোর্ডের মেয়েটাকে ও মনে মনে ভালবাসত।  কিছুক্ষন বাদে তার চোখ চলে যেত মাথার ওপর রাতের অন্ধকারের সুযোগে অনেকটা নেমে আসা আকাশে। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার, ঠিক মনে নেই বাবাই হবে, তার শেখান নানান নক্ষত্র মণ্ডলী দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে চোখ লেগে আসত তার। একেবারে ঘুমিয়ে পরার আগে একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তির সঙ্গে ভাবত সারাদিন সে কত পরিশ্রম করে, কোন কাজে একটুও ফাঁকি দেয় না, মানুষ সবাই ওকে কত ভালবাসে। একটা আত্মপ্রসাদ এসে ঘিরে ধরত তাকে, মায়ের মতো; আর ঘুম জড়িয়ে আসত পাগলের দু চোখ ভরে। নেড়ি কুকুরটা এসে লেজ গুটিয়ে কখন যে শুয়ে থাকত ওর পাশে ও টেরই পেত না ।

এমনি করে কেটে যাচ্ছিল মাস, দিন, বছর; বোধহয় জীবন ও।  

তারপর একদিন হটাত এক কাণ্ড ঘটল…

ক্রমশ

দ্বিতীয় পর্বের জন্য ক্লিক করুন

error: Content is protected !!