bonshodhara

মাংস খান তো? 

নিশ্চয়ই, খুব ভালোবাসি

শুয়োর হলে আপত্তি আছে কি, কারণ ঐটি আমার ভাঁড়ারে আছে,আর কিছু আজ জোগাড় করা মুশকিল,  কুড়াতলির হাট শুক্রবারে বসে, আজ তো মোটে বুধবার। 

আরে আপনি এত কিন্তু কিন্ত করছেন কেন শক্তিবাবু, শুয়োর আমার হট ফেবারিট… 

ওঃ,গুড গুড, যুগল ও যুগল-

বলুন স্যার?

শোনো, আমি যেমনটি খাই,ঠেলে তেমনি করে বানাবে শুয়োরের বাচ্ছাকে। ঝাল মিডিয়াম, সেদ্ধ তুলতুলে- আর তোমার  আটা আছেতো-খান পনেরো পরোটাও বানাও,মাংস দু কিলো পুরোটাই বানিয়ে ফেলো, কেমন?

না, না, অত আবার কেন?  

আরে খানতো মশাই, আজ বাদে কালতো চলেই যাবেন, আমি,আপনি, যুগল আর আমার ড্রাইভার সুখন চারজনে দুকিলো খেতে পারবো না? আর খেয়ে নিয়ে আমাদের পুলকূম ঝরনার এক বোতল জল চোঁ-চোঁ করে মেরে দেবেন, দেখবেন সব দশ মিনিটে হজম, আরে এ জলে টি এম টি বার হজম  হয়ে যায়….

যুগল, ২ ঘন্টায় রান্না রেডি হবেতো? 

এক ঘন্টায় রেডি হয়ে যাবে স্যার, মাংস আমি  মেখেই রেখেছি- আর আটার লেচিও কাটা আছে-

ওরে শালা, তোমার পেটে পেটে এত, যাঃ শালা, পালা এখন- রায় সাহেবকে হাতের গুন দেখিয়ে দিয়ে হবে কিন্তু, খেয়ে যেন হাত চাটেন- ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়।

আসি স্যার-

আয়, আর তপনকে বলতো… 

আপনার রামের বোতল, দুটো গ্লাস,আর ডালমুটের শিশিটা তো স্যার… 

আরে ব্যাটা, যুগল বিনে শক্তি অচল… যা দূর হ আমার সামনে থেকে.. 

আচ্ছা, শক্তিবাবু, কিছু মনে করবেন না, এই বনের মধ্যে থাকতে আপনার ভালো লাগে, কতদিন আছেন?   

তা, অভীকবাবু, বছর কুড়ি তো হলোই, আর এটাই তো আমার জীবিকা মিঃ রায়, বন বাঁচানো, বন বাড়ানো।  জন্তু বাড়ানো, জন্ত বাঁচানো। সরকার তো এইজন্যই আমাকে মাসে মাসে মাইনে দেয়। তবে একটা সত্যি কথা বলি আপনাকে, এখানে থেকে থেকে অনেক দিন ধরেই এই বনভূমি ছাড়া আর কিছু ভালো লাগেনা, টাউনে গিয়ে মন পালাই পালাই করে, একদিনের জন্য ও ভালো  লাগেনা। আর আছেই বা কে বলুন- ছিলেন এক বুড়ো মামা আর বুড়ি পিসী। তা, সেই  বুড়ো বুড়ি তো গতবছর শীতকালে পর পর চোখ বুজলেন। পিসী ছোট ছেলের কাছে থাকতেন, আর মামা আমার মতোই সারাজীবন আমার মতোই ব্যাচেলার ছিলেন, তাই তাঁর একতলা বাড়িটা আমারই ভাগে পড়লো, জানেন, শ্রাদ্ধের পর দিন তিনেক ছিলাম ও, তারপর আর টিকতে পারলাম না। বাড়ি তালাবন্ধ করে, চাবি আমাদের উকিল সুবিমলবাবুর কাছে দিয়ে, নিশ্চিন্ত। সুবিমল বাবু শুনেছি মামার ফিক্সড ডিপোজিট এর সুদ থেকে এক কেয়ারটেকার রেখেছেন।  সে নাকি রোজ গিয়ে ঝাড়পোঁছ করে আসে- এই দেখুন, একটা সামান্য প্রশ্নের উত্তরে  বকর বকর করে এক মস্তো গপ্পো ফেঁদে বসলাম। কিছু মনে করবেন না, আসলে কথা বলার লোক পাইনা তো…

আরে, না, না, তাতে কি, আমার তো ইন্টারেস্টিংই লাগছে। 

তাই.. আঃ তপন, এতক্ষণে তোমার সময় হোল বাবা, বকে বকে গলা যে শুকিয়ে গেলো, ঢাল ব্যাটা, পাতিয়ালা পেগ ঢাল, অভীকবাবু, আপনাকে একটা ডাবল দিক, ওই যা, আপনি মধু খান কিনা সেটাই তো জিজ্ঞেস করিনি, চুপচাপ ছিলেন বলে সম্মন্তি লক্ষণম বলে ধরে নিয়েছি। আপনার চলে তো, ও মশাই।

খুব চলে, আর পরের পয়সায় হলে, গরীব ইস্কুল মাস্টারের তো রীতিমতোই চলে।

হা,হা,হা,যাক বাঁচা গেল, মশাই খুব অন্তর টিপ্পুনী দিতে পারেন তো। বন্নচোরা আঁব দেখছি আপনি! খান,খান, উল্লাস। 

উল্লাস। 

আঃ, এইবার ধড়ে প্রান এলো, আমায় শুকনো সন্নেসী করে রাখিস না মা, আমায় রামেভাতে রাখ, আমার এক চেলা আছে বুঝলেন, আইরিশ ছোকরা, ব্যাটার ফোটো তুলবার খুব শখ, প্রায় ফি বছরই এখানে আসে, আমাকে গুরু মেনেছে। আসলেই একবারে বিলিতি মাল হাতে করে আসে। বড় ভালো ছোকরা। এরকমই সবার ভালোবাসাতেই চলে যাচ্ছে, বুঝলেন কিনা, হেঃ,হেঃ,হেঃ- তা আপনার কথা তো কিছুই জানা হোলোনা

অভীকবাবু- আপনার গপ্পোটপ্পো কিছু ছাড়ুন  মশায়, চুপ্পা বসে থাকলে চলবে?

আমার আর কি গল্প থাকবে শক্তিবাবু, মফঃস্বলের ইস্কুলে নাইন টেনে ইতিহাস পড়াই, তার সাথে ইলেভেনের বাংলা ক্লাসও মাঝেমধ্যেই নিতে হয়, আমার বাংলা স্যার আবার অঞ্চল প্রধান ও তো, তাই বেশিরভাগ দিন ইস্কুলেই আসতে পারেন না, হেডস্যার আর উনি দুজনেই একই পার্টি করেন, তাই বুঝতেই পারছেন….

হুঃ৷ সব জায়গায় একই গন্ডোগোলস… 

শুধু আপনার এই বনে ছাড়া, তাইনা শক্তিবাবু, এখানে যা ঘটে, সব সরাসরি- হয় মরো, নাহলে মারো- কি তাইনা?

না,না, ঠিক তা নয় মিঃ রায়, এখানেও সবাই ভয়ে ভয়েই বাঁচে- এই বুঝি জানটি খোয়াতে হলো-

সেকি মশাই, সে তো না হয়, হরিন,শুয়োর, বাঁদর, খরগোস, পাখিদের বেলায়- কিন্তু বাঘ, তার কাকে ভয়? সবাই তো তারি ভয়ে থরহরি কম্প!

এইটা অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন,ও ব্যাটার কাউকেই ভয় নেই – শুধু একজন কে ছাড়া… 

কে সেই একজন শক্তিবাবু? 

কেন, উত্তর তো সোজা,  আর একটা বাঘ,আর একটা মদ্দা,তার থেকেও যার কম বয়স, গায়ের জোর বেশি, দাঁতে নখে যার আরো বেশি ধার….

আপনি এই লড়াই কখনো দেখেছেন?

দেখিনি আবার, বেশ কয়েকবার দেখেছি- আর যে হেরো পাট্টি, তার যে কি অবস্থা হয়, তা আর আপনাকে কিকরে বলবো অভীকবাবু- অত ক্ষমতাবান প্রাণীকে দেখলে তখন মায়া হয়, সারা গায়ে কাটা ছেঁড়া – আস্তে,আস্তে,শরীরটাকে টেনে টেনে জলের কাছে গিয়ে শুয়ে থাকে,আর মাথাটা তুলে একটু একটু করে জল খায়। সে দশা দেখা যায়না অভীকবাবু! 

একি, আপনি কাঁদছেন?

না,না, ও কিছু না, ওকথা থাক, চলুন ঘরে গিয়ে বসি,রান্না বোধহয় হয়ে এলো, এখানে সন্ধ্যেয় ঠান্ডা পড়ে, আপনি শহরের মানুষ, সহ্য হবেনা।

না, আপনি কিন্তু কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন শক্তিবাবু,আমি তো ভাবতেই পারিনি যে আপনার মতো লোকের চোখে এই সামান্য কারণে জল চলে আসবে!

কেন, আমাকে কি দেখলে খুব কঠোর লোক বলে মনে হয়? 

না,না, তা কেন, খুব strong willed লোক বলে মনে হয় আরকি।

তাই? তা কটা strong willed লোক আপনি  জীবনে দেখেছেন? 

আপনার মতো আর কাউকেই দেখিনি, তাই ভাবছিলাম… ওকি! ওটা কিসের আওয়াজ?

কি হলো, আপনি ভয় পেয়ে গেলেন দেখছি, ওতো, বিক্রম, ছায়াকে ডাকছে।

কে বিক্রম, কে ছায়া?

ওই যাদের কথা আমি আপনি আলোচনা করছিলাম, ওরা তো তারাই।

কিন্তু, কিন্তু কি ভীষণ আওয়াজ,

সেকি, অভীকবাবু, প্রেমের আহ্বানকে আপনার ভীষণ আওয়াজ মনে হচ্ছে? আপনি নাকি কবিতা লেখেন,সকালে একবার বলেছিলেন না- ওই,ওই বিক্রম বোধহয় ছায়ার কাছে ঘেঁষতে পারলো, এই গান না গাইলে ছায়া ওকে ভালোবাসবে কেন? শুনছেন, চারিদিকে এরবারে সাড়া শব্দ নেই। এখন ওদের একে অন্যেকে ভিতরে নেবার সময়, তা না হোলে ছায়ার ছানা হবে কি করে, এবার ওদের বংশধর থেকে যেতে হবে যে স্যার, সেটাই তো আমার দায়িত্ব,অভীকবাবু। বিক্রমের দুই পুরুষ আগের পূর্বপুরুষ ওস্তাদের সাথে লড়াইএর ফলেই তো আমার দিন শেষ হয়ে গেলো – ছানাপোনা করতে পারলাম না- আমার বংশ রইলোনা স্যার- পূর্ণ চাঁদ দিকে তাকিয়ে  তাকিয়ে নিজের গায়ের ঘাগুলো চেটে চেটে চোট ঠিক করবার অত চেষ্টা করেও পারলাম না, ওস্তাদ একেবারে গলাটা কামড়ে দিয়েছিলো তো, ওখানে তো জীভ বাড়িয়ে নাগাল পাওয়া যায়না,তাইনা, বলুন? তাই ক্ষতটা আর সারাতে পারলাম না। আস্তে,আস্তে আমার মাথাটা তাই নেমে এলো, চোখটা বুজে এলো,  আর একসময় আমার প্রকান্ড ডোরাকাটা শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠে  স্থির হয়ে গেল। game over, বুঝতে পারছেন স্যার, আমার যে বংশধর হলোনা অভীকবাবু, তাই কেউ প্রতিশোধ নিতে পারলো না। এবারেও বয়স তো প্রায় পঞ্চান্ন হলো স্যার,এবারেও একই পরিনতি, বংশধর এবারও থাকবে না। দেখা যাক, অভীকবাবু   পরের বার কি হয়।

 

 

সমাপ্ত

error: Content is protected !!