ekta iccha 3

এর পরের দুদিন রাখী আর স্কুলে গেল না। সারাদিন বাড়িতে রইল দুটি নির্বাক প্রাণী আর মীরা রোডের তিন তালার দু কামরার ফ্ল্যাট ঢেকে রইল উনুনের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মত একটা অস্বস্তি আর গাঢ় নৈঃশব্দেলেখার টেবিলে বসে যতবার বানী ভাবল এইবার রাখী এসে মায়া’র ব্যাপারে কোন একটা কথা শুরু করবে ততবার রাখী নেহাতই দু একটা আপাত তুচ্ছ সাংসারিক কথা বলে চলে গেল। বানী নিজে থেকেও এই প্রসঙ্গের উত্থাপন করব করব করেও করে উঠতে পারল না। 

সন্ধ্যেবেলা দু জন মায়াব্রত’কে ভিজিটিং আওয়ার্স এ গিয়ে দেখে এল। যা কথা বলার রাখী’ই বলল ছেলের সঙ্গে। মায়া খালি একবার হেসে বানীকে বলল, ‘কি গো বাবা একেবারে থম মেরে গেছ তো। আরে আমার কিচ্ছু হয় নি। তোমাদের কোন ভয় নেই। কার্নেগী মেলান থেকে অ্যানিমেশন মেজর না করে মরব না। ফার্স্ট ইয়ার থেকে স্কলারশিপ ও পাব.. খালি সময় আসতে দাও.. আপনা টাইম আয়েগা..’ তারপর নিজের রসিকতায় নিজেই এমন জোরে হেসে উঠল যে ভিজিটিং আওয়ার্সের বেশ ভীড় থাকা ওয়ার্ডের সবাই একবার তাকিয়ে নিল ওর দিকে। বানী খেয়াল করল রাখী ও মৃদু হাসল। ‘যাক, তাও ভাল’ বানী ভাবল। কিন্তু বানীর নিজের কেন জানিনা একটুও হাসি পেল না। 

এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে বলা হল পেশেন্টের কাল ছুটি হবে।

***

তার পরদিন, বেলা বারোটা নাগাদ দরজায় ঘন্টি। 

বাড়ি থাকলে রাখী’ই দরজা খুলবে এই অলিখিত নিয়মে দরজা খুলে রাখী দেখে লোকাল থানা থেকে দু জন পুলিশ। এস আই সদাশিভ কাম্বলে, সঙ্গে একজন হাবিলদার। রাখী ওনাদের বসিয়ে রেখে বানী কে ডেকে আনে। সদাশিভ নমস্কার করে এইভাবে অসময়ে আসার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে জানিয়ে দিলেন থানার বড়বাবু নিজে চান না ছেলেকে কে নিয়ে এতবড় একটা ‘হাদসা’র পর ওনাদের থানায় ডেকে কোন রকম অসুবিধায় ফেলা হোক, অতএব শুধু মাত্র ডিউটির খাতিরে ওনার এখানে আসা। পুলিশের এই অমায়িকতায় বানী অনেকটাই যেন সাহস ফিরে পেল, বলল ‘বলুন কি জানতে চান?’ এরপর কথা যেভাবে এগোল তাতে বানী আর রাখী স্পষ্ট বুঝতে পারল মায়াব্রতকে খাবারের সঙ্গে যে বিষ দেওয়া হয়েছিল নানাবিধ রিপোর্টে সেই ব্যাপারটা নিয়ে আর কোন ধোঁয়াশা নেই। সেটা স্পষ্ট এবং প্রমাণিত। ওনাদের বক্তব্য বানীরা এখন না চাইলেও এই ইনভেস্টিগেশন পুলিশ কে চালাতেই হবে। এই কেস সাধারণ কেস নয়। আ ডেফিনিট কেস অফ পয়েজনিং পারহাপ্স উইদ আ মোটিভ টু কিল। মোদ্দা কথা ‘অ্যান এটেম্পট টু মার্ডার কেস’এই কেস পুলিশের পক্ষে বন্ধ করে দেওয়া খুব শক্ত। বানী সোফায় বসা, পাশে রাখী দাঁড়িয়ে। দুজনেই প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে সদাশিভের এই কথাগুলো শুনল। সদাশিভ থেমে যাওয়ার পর ক্ষনিকের স্তব্ধতা । এর মধ্যে বানী যখন মনে মনে নিজের বক্তব্য ঝালিয়ে নিচ্ছে তখন রাখী প্রথম কথা বলে উঠল। বানী দেখল এই প্রথম রাখী’র চোখে জলভিজে চোখে আর কাঁপা হাতে হাত জোড় করে রাখী বলল, ‘ইন্সপেক্টর স্যর, আপকো যো করনা হ্যায় কিজিয়ে.. হামকো কেয়া করনা হ্যায় বোলিয়ে.. দোষীকো প্লিজ ছোড়না মত.. মুঝে ইসকি অন্ত দেখনি হ্যায়..’

‘ফির তো সমঝো ম্যাডাম এইসাচ হি হোগা’ বলে সদাশিভ উঠে পরেন। সামনে জলের গ্লাস আর মিষ্টি তেমন ধরাই পরে থাকে। একেবারে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সদাশিভ বলেন, ‘মেরা নাম্বার রাখ লিজিয়ে ম্যাডাম.. কভি কোই বাত জরুরী হো তো ফোন করনে সে ঝিঝকনা মত’রাখী সদাশিভের নাম্বার সেভ করে নেয় নিজের ফোনে।

‘নমস্কার ম্যাডাম। নমস্কার মিঃ নান্দী’ সদাশিভ এগিয়ে যান লিফটের দিকে। পেছনে হাবিলদার।

সেকেন্ড তিরিশেক পরে লিফট বন্ধ হওয়ার আর ওদের তলার বাকি তিন প্রতিবেশীর দরজা বন্ধ, এই আওয়াজ একসাথে বানীর কানে এল।   

***

হাসপাতাল থেকে ট্যাক্সিতে উঠে মায়াব্রত বারবার জিজ্ঞেস করল বানী কেন এল না। রাখী একসময় জবাব দিল, ‘তোমার বাবার শরীর ভাল নেই’ পুলিশের কথাটা মায়াকে বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। মায়া চুপ করে মায়ের হাত ধরে বাকি রাস্তাটা বসে রইল। রাখী ছেলের হাতে হাত বুলিয়ে খালি একবার জিজ্ঞেস করল, ‘এখন আর কোন কষ্ট নেই তো রে?’ ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ওদের ট্যাক্সিটা গোরেগাঁও ফ্লাইওভার ক্রস করছিল। মায়া দেখল নীচে ওবেরয় মলে ‘মুগলী’র’ এর একটা বিরাট ব্যানার। মুগলী ছাড়া বাকি সব ক্যারেকটার অ্যানিমেটেড। অসাধারণ কাজ। একটা বিষাদ খেলে গেল মায়ার চোখে; ব্যানার থেকে চোখ না সরিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না মা কোন কষ্ট নেই’।

বাড়ি এসে বেশ কয়েকবার বেল বাজিয়েও বানী দরজা না খোলায় রাখী ‘অদ্ভুত একটা লোক’ বলে নিজের চাবি দিয়ে দরজা খোলে। সাতটা বাজলেও বাইরে এখনো যথেষ্ট আলো। দরজার পাশে জুতো খুলে মায়া শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়, ‘বাবা, ও বাবা.. ঘুমোচ্ছ নাকি এখনো?’ রাখী যায় রান্নাঘরে চায়ের জল বসাতে।

শোবার ঘরের দরজা ঠেলে মায়া ঘরে ঢোকে।

রাখী রান্নাঘরে সসপ্যানে জল নেয়গ্যাস জ্বালাবে বলে লাইটার হাতে নিতেই ‘মা’ বলে মায়ার একটা চাপা ভয়ার্ত চিৎকারে রাখী চমকে ওঠে। ‘কি হল?’ রাখী রান্নাঘর আর শোবার ঘরের মাঝখানের পা দশেকের দূরত্ব দ্রুত অতিক্রম করে ঘরে আসে। মায়া সিলিং এর থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখী কে জাপটে ধরে।

সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা বানী’র ফুট ছয়েকের নিথর দেহ বিছানা থেকে দূরে, পাখার একটা অব্যবহৃত হুক থেকে হলুদ মোটা নাইলনের দড়ি বেয়ে ঝুলছে মেঝেতে একটা লাল প্লাস্টিকের টুল কাত হয়ে পরা। মৃতদেহের ঘাড় ভেঙ্গে কাত হয়ে একদিকে হেলে পরেছে। জীভ বেরিয়ে এসেছে প্রায় পুরোটাই। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত এসে থুতনিতে জমাসেই রক্ত কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে এসে পরেছে পাঞ্জাবীতে। 

রাখী এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। নজরে আসে কিছুতেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারবে না এমন ভাবে টেবিলে রাখা একটা খামের ওপর; রাখী’র নাম লেখা

এক হাতে খাম আর আরেক হাতে ছেলের হাত ধরে ভেতরের ঘরে ঝুলন্ত বানীকে রেখে রাখী এসে বসে বাইরের সোফায়।

খাম খুলে বার করে পরিষ্কার তিন ভাজ করা একটা এ ফোর কাগজ, তাতে বানীর ছোট্ট বয়ান । মুক্তোর মত অক্ষরে নিজের হাতে লেখা

প্রিয় রাখী ,

বম্মা’র মৃত্যুর পর বালাজী ফিল্মসের ডাক পেয়েছিলাম। আমার প্রথম ছবির। তোমার মনে না থাকার কোন কারন নেই।

উমেশ ভাটের ডাক যখন প্রায় ভেস্তে যায় যায় তখন জেঠুমনি’র মৃত্যু আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমার প্রথম হিন্দী ছবি আর এই মুম্বাইতে আসা। 

বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাইছি?

অর্থাৎ আমার এই শুধু ছবি বানানোর ইচ্ছেতে বেঁচে থাকার জন্য দরকার নিরন্তর মৃত্যুর জোগান। মায়া কলা খেতে ভালবাসে না আমি জানি। সেই রাত্রে কলায় বিষ মিশিয়ে রেখেছিলাম। জানতাম তুমি টোস্ট আর কলা খেয়ে রোজ স্কুলে যাও। তারপর কি ভাবে কি হল, সেই কলা মায়া খেল কেন এখন আমার জানার আর কোন ইচ্ছে নেই। তবে তোমার আর পুলিশের আছে।  

তোমাদের কাজ সহজ করে দিলাম।

ক্ষমা চাইব না কারন ক্ষমা করার মত কাজ আমি করিনি।

বানী।   

রাখী আর মায়া চুপ করে বসে থাকে। বাইরের অন্ধকার বসার ঘরে নেমে এসেছে। সাইকেলে করে আসা ডিমের ছেলেটা নীচে অনেকক্ষণ ঘন্টি বাজিয়ে চলে গেল। তার মানে আটটা

দুজন’কে প্রায় চমকে দিয়ে মায়াব্রত’র ফোন বেজে ওঠে । অচেনা দীর্ঘ একটা নাম্বার। ফোন ধরার আগে বানীর ঝুলন্ত দেহটা মায়ার সামনে যেন একবার দোল খেয়ে গেল। মায়া ভেতর থেকে কেঁপে উঠল একবার।

‘হ্যা.. হ্যালো?’

‘অ্যাম আই ঠকিং ঠু মাহ-য়া-ব্রা-ঠো?’ এক সাহেবের ভারী কন্ঠস্বর।  

‘ইয়েস মায়া হিয়ার..’

‘মাহ-য়া, হাই, দিজ ইজ স্টারলিং.. স্টারলিং ল্যাম্বার্ট ফ্রম কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি..’

‘হাই স্টারলিং’ মায়ার গলা শুকিয়ে কাঠ, ‘হোয়াট ইজ ইট এবাউট?’

মিনিট দুয়েক কথা বলে মায়া ফোন ছেড়ে রাখীর দিকে তাকায়। রাখীর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা ওরা আমায় ফুল স্কলারশীপ অফার করেছে.. আগামী সেশন এ জয়েন করতে হবে..’

রাখী নিঃস্পন্দ, নির্বাক হয়ে বসে থাকে। মায়াব্রত তার মায়ের এরকম চেহারা কোনদিন দেখেনি। একটা অজানা ভয়ে রাখীকে জড়িয়ে হাউহাউ কান্নায় ভেঙ্গে পরে মায়াব্রত।                       

সমাপ্ত

প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

error: Content is protected !!