anyo jagat

ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর ছেলে নেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ আর্মি তে পাঁচ বছরের চুক্তি করে। যুদ্ধ শেষে তাদের সবাইকেই স্বেছাবসর নিতে বলা হয়। রমেন্দ্র ছিল তাদের মধ্যেই একজন, তখন আর্মি থেকে বেরিয়ে এসে সে West Bengal National Volunteer Force এ Company Commander পদে আসীন হয়। যুদ্ধের অনিশ্চয়তা আর নেই, কাজ ও অনেক অন্যরকম, যেটা তাকে খুব আকর্ষণ করেছিল সে কাজটা হলো তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধান চন্দ্র রায় এর তত্বাবধানে কল্যাণী উপনগরী আর দুর্গাপুর ইস্পাত নগরী এই দুটি গড়ে তোলা। NVF এর ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পরে এই কাজের গুরু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়।

এই সময় তাকে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে তদারকির কাজে যেতে হতো। একবার মাজদিয়া ছাড়িয়ে কোনো এক অখ্যাত গ্রামে তাকে যেতে হলো কর্মীদের বেতন দেবার জন্য। যাত্রা শুরুই করেছিল দুপুর বেলা, বাস যখন গ্রামের মূল সড়কে নামালো তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে, সঙ্গে একটা রিভলভার, টর্চ আর এক সুটকেস ভর্তি টাকা। মোড়ের দোকানদার বলল ওই ক্যাম্প এ যেতে প্রায় মাঝরাত য়ে যাবে, পথে একটা ঘন জঙ্গল ও পেরোতে হবে, কাজেই সকালে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু রমেন্দ্রর জেদী মন বলল এতটা যখন আসাই গেছে তখন বৃথা সময় নষ্ট না করাই ভালো, টর্চ আর রিভলভার আছে , কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়।

শুরু করলো পথ চলতে, অমাবস্যাই ছিল বোধহয়, কারণ ঘণ্টা দুএক পর যখন সে জঙ্গলের পথ ধরল কিছুই আর দেখা যাচ্ছিল না। এক হাতে টর্চ আর আরেক হাতে সুটকেস। ঝিঁঝি পোকা’র ডাক আর তার নিজের ভারী বুটের আওয়াজ; লেফট রাইট, লেফট। হাঁটতে তার ভালই লাগে, আর ভয় কাকে বলে সে তো জানেই না। কিন্তু খানিক পর, তার শ্রবণেন্দ্রিয় কিছু একটার যেন আভাস পেলো, কেউ যেন শুকনো পাতা মাড়িয়ে তার পিছু পিছু আসছে।

তক্ষুনি তার মনে হলো, এ নির্ঘাত ডাকাত, ওই বাস থেকে নামার পরই টাকার জন্য পিছু নিয়েছে। লোকালয়ে সুবিধা করতে পারেনি এবার জঙ্গলে বাগে পেয়েছে। সে আলতো করে রিভলভার’টা ছুঁয়ে নিল, আর একটু জোরেই পা চালালো। ওমনি পেছনের শুকনো পাতা মাড়িয়ে আসার শব্দের গতিও বাড়লো। যুদ্ধের বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মন অত্যন্ত বাস্তববাদী, কিন্তু তবুও কেন জানি তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় জ্যাঠাইমার সাবধান বাণী, ছেনো, রাত্তির বেলা যতই কেউ নাম ধরে ডাকুক অথবা পিছু নিক তুই কিন্তু বাবা পিছন ফিরে তাকাসনে, কথা দে!; হেসেছিল সে, কিন্তু আজ কি এক অজানা আশঙ্কায় একটু হলেও বিচলিত হলো। সামনা সামনি শত্রুর মোকাবিলা আর আত্মগোপনকারী কোনো অজানা আক্রমনকারী কে পরাস্ত করা সম্পূর্ণ আলাদা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো ওই খসখস আওয়াজ একই লয়ে বাজছে, না দ্রুত না বিলম্বিত, যেন সে শুধু অপেক্ষা করছে তার পিছন ফিরে তাকানোর, ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। নাহ, আর পারা যাচ্ছে না, সে একটু থমকে দাঁড়াল, উচ্চস্বরে বললো “Who’s there?”; কোনো সাড়া নেই, আবার চলা শুরু আর আবার পিছু নেয়া। অবশেষে ব্যারাক বাড়ির একটু ক্ষীণ আলো দেখা গেলো, রাস্তা টপকে সে এক দৌড়ে বাড়ির দরজায়। আর কোনো আওয়াজ শোনা গেলো না। রাত তখন ২ টো হবে। এবার সে খুব জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগলো, ডাকলো ছেলেদের নাম ধরে, কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে যে তারা মৃদুস্বরে কথা বলছে, কিন্তু কেউই সাড়া দিচ্ছে না। এতো ভারী অদ্ভুত, অবশেষে রমেনের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো,

“এই হারা…. রা, আমি শা.. তোদের টাকা পয়সা নিয়ে সারা রাত হাঁটছি আর তোরা কিনা …..”। ব্যাস মন্ত্রের মত কাজ হোলো দুদ্দাড় করে সব নীচে এসে দরজা খুললো,

“একি স্যার আপনি?? আমরা ভেবেছিলাম…..!”

“কি, কি ভেবেছিলি হতভাগা র দল?”

“আচ্ছা ও সব কথা এখন থাক স্যার, আপনি একটু খেয়ে বিশ্রাম করুন।“

পরদিন সকালে জলখাবার খেতে খেতে রমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলো কেন তারা দরজা খোলেনি। তাতে তারা যা বললো তার সারমর্ম হলো, এক মাস আগে বিহার থেকে আসা ব্যাটেলিয়ান এর একটি ছেলে কলেরায় মারা যায়, তার পর থেকেই প্রতি রাতে প্রতিটি ছেলের নাম ধরে কেউ ডাকে, ওরা জানলা দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও কাউকে দেখতে পায়নি। জায়গাটা প্রায় পাণ্ডববর্জিত, তায় আবার সামনে ওই জঙ্গল, তাই তারা ধরেই নিয়েছিল এটা নিশির ডাক, ওই ছেলেটির অতৃপ্ত আত্মা বন্ধুদের সঙ্গ চাইতে আসে। এবং গতরাতে স্যার এর ডাককেও ওরা নিশির ডাক ভেবেই আর সাড়াশব্দ করেনি। শেষে গালিগালাজ শুনে তাদের ভুল ভাঙ্গে। রমেন্দ্র এর সত্যাসত্য বিচার করার চেষ্টাও করেনি, কারণ সে নিজেই কেমন এক ঘোরের মধ্যে ছিল, কে ছিল তার পিছনে সারা রাত? কোনো অশুভ আত্মা নাকি দেবদূত যে তাকে আগলে রেখেছিল?

ব্যাখ্যা মেলেনি!

ক্রমশ

error: Content is protected !!