poribar (1st)

সুমিত সান্যালের সঙ্গে আমার পরিচয়, হ্যাঁ তা প্রায় বছর দশেক তো হবেই।

চল্লিশের ওপারে আমার বন্ধুরা, যারা কন্যাদায়গ্রস্ত, তারা যখন ফেসবুক একাউন্ট খুলে ‘গোপনে মদ ছাড়ান’ স্টাইলে হবু-জামাইকুলের প্রোফাইল দেখে বেড়াত আর পুত্রসন্তানের পিতা হলে তাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করে তোলাবার দুশ্চিন্তায় মিউচুয়াল ফান্ড খায় না গায়ে মাখে গুগল করত, সেই বয়েসে আমি ড্যাং ড্যাং করে মোটা মাস মাইনের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চিত্রনাট্যকার হবার অবাধ্য, ডানপিটে ভূতের পিঠে চড়েছিলাম। সে ভূত যে যে কোনদিন পিঠ থেকে ফেলে দিতে পারে সেটাও প্রথম ছ’মাসেই হাড়েহাড়ে বুঝে গেছিলাম। তবু হাল ছাড়িনি।

সুমিতের সঙ্গে আমার সেই নতুন ‘স্ট্রাগলার’ জীবনের একদম গোড়ার দিকে আলাপ। 

আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, ফর্সা, গোলগাল, চোখে চশমা, সুমিত’কে দেখে চিত্রপরিচালক কম প্রফেসর বেশি লাগত। সেটাও যে মন্দ ভাবিনি আলাপের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম। সারা বিশ্বের সিনেমা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য যেন ওর মাথায় থাকথাক সাজানো। কোন সীন বা সিচুয়েশন বা প্রেমাইস, শুধু বললেই হল, সুমিত মিনিটের মধ্যে জাপান থেকে হলিউড, ভায়া ইরান, হাফ ডজন ছবির রেফারন্স দিয়ে দেবে। ও সিনেমাটা ভালবাসত। আর আমি? সদ্য পা রাখা এই দুনিয়ায় ওর এই প্যাশনে যেন নিজের মুক্তির একটা ছবি দেখতে পেতাম। কিসের মুক্তি না জেনেই। ১৮ বছর সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টার চাকরি যারা করেছেন বা করে চলেছেন একমাত্র তাঁরাই আমার এই কথার মানে ধরতে পারবেন।

সদ্য কলেজে ঢোকা যুবতীর পাড়ার পি এইচ ডি করা দাদা’কে দুর্গা পুজোর প্যান্ডেলে দেখে মুগ্ধ হওয়া আর তাকে ‘আমার সঙ্গে কফি খেতে যাবেন’ বলার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান কাজ করে, সুমিতের সঙ্গে আমার তেমন হত। সুমিত তখন বাংলা টেলিভিশনের মধ্যগগনে হুহুংকার বিরাজিত। ওর এনে দেওয়া টি আর পি’র ঘাটে প্রোডাকশন হাউজের মালিক আর চ্যানেলের রিজিওনাল হেড তখন এক গেলাসে দারু খায় সেখানে আমি কি করে বলি তোমার কোন প্রজেক্টে আমায় নাও। সেটা আর হয়ে ওঠে নি। কিন্তু বন্ধুত্ব হাল্কা থেকে ঈষৎ গাঢ় হয়েছে। যাতায়াত শুরু হয়েছে একে অন্যের বাড়ীতে। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে নেমে বি কে পাল এভেনিউ – আহিরিটোলা’র দিকে যেতে ডানদিকে ওদের বিশাল পৈতৃক বাড়ি। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। ওই বিশাল বাড়ীতে কয়েক ঘর ভাড়াটে, একতালায়। দোতলায় সুমিত আর ওর মা। ব্যস। সুমিত নিজে কোনদিন ওর আত্মীয়স্বজনের কথা বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। বরাবরের নিয়ম ছিল সুমিত বাড়ি ঢুকেই সোজা চলে যেত নিজের ঘরে। আমি পেছন পেছন। দেখেছি ওর মা, বসার ঘরে, যেটা পেরিয়ে সুমিতের ঘরে যেতে হয়, সেখানে বসে টিভি দেখছেন। এক দুবার এরম হওয়ার পর একদিন নিজে থেকেই ‘মাসিমা, আমি পরাগ’ বলে প্রণাম করেছি। মাসিমা হাত তুলে আশীর্বাদ করে আবার টিভিতে ফিরে গেছেন। চা বিস্কুট চলে আসত যথাসময়ে। ত্রুফো – গোদার – সত্যজিত – স্করসেসে হয়ে আড্ডা থামত ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গড়িয়াগামী লাস্ট মেট্রো ধরার মত সময়ে।

***

কর্পোরেট সাপ লুডো একবার যিনি খেলে ফেলেছেন তিনিই জানেন এ খেলা কি বিষম বস্তু। পাক্কা নেশা। ‘আরও আরও প্রভু আরও আরও..’ অর্থাৎ আপনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হন অথবা সেই চাকরি ছেড়ে চিত্রনাট্যকার, এই খেলা আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই যাবে, আপনার ডি এন এ বাহিত হয়ে। চিত্রনাট্য লেখা শুরু’র দু বছরের মধ্যে বুঝে গেলাম যদি লিখে কিছু করতে চাই আমাকে ভারতীয় সিনেমা’র মক্কায় যেতে হবে। ততদিনে অধিকাংশ সঞ্চয় ফুড়ুৎ এবং আয় আগের এক তৃতীয়াংশ হয়ে যাওয়ায় ছেলেকে শস্তায় হিস্ট্রি অথবা ইংরেজি পড়ার উপদেশ দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বিপুল দেমাকে ‘এয়ারপোর্ট চলিয়ে’ বলেই জীভ কেটে তৎক্ষণাৎ বলতে হল ‘সরি ভাইয়া হাওড়া চলিয়ে’ আমি মুম্বাইয়ে পাড়ি জমালাম। ট্রেনে।

এরপর বাংলার চারাপোনা আরব সাগরের ঢেউ এর মাথায় দিবারাত্র নেত্ত করতে করতে আর ধোবিপাট খেতে খেতে আরো কয়েক বছর কাটিয়ে কোনমতে এক জায়গায় থিতু হল। তিমিমাছ হতে না পারলেও চারাপোনার গন্ধ গা থেকে মুছে গেল  কিন্তু মন খারাপ করা, মুম্বাইয়ের অবিরত বৃষ্টির কোন এক সকালে ফোনে আমার পুত্রের মায়ের বিরহাশ্রু মুছিয়ে, জলদি বাড়ি ফেরার মিথ্যে স্তোক দিয়েই সুমিত’কে নেক্সট ফোনটা করতাম। অদ্ভুত একটা ভাল লাগায় মন ভরে যেত। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে প্রত্যেকবার বলতাম ‘সুমিত আমি আর তুমি কিন্তু একসঙ্গে কাজ করবই, নো ম্যাটার হোয়াট’ অথচ ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে হত আমার যত উৎসাহ ওর তার আদ্ধেক ও যেন নেই  পরক্ষনেই ভাবতাম আমি তো আলেজন্ডার দা গ্রেট বা টলেমী নই যে এরিস্টটল আমায় শেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। কিন্তু অনায়াসে মেনে নিতাম সুমিত এরিস্টটল। কথায় কথায় বুঝতাম সুমিত আমার সঙ্গে কাজ নয়, অন্য কিছু একটা বলতে চায় অথচ মন খুলে বলে উঠতে পারে না। আমার জোরাজোরি করার স্বভাব একদম না থাকায় সেই প্রাচীর হয়ত রয়ে গেল। কে জানে। উলটে প্রাচীর গাত্র ভরে উঠতে লাগল আমাদের অবান্তর আলোচনার বুনো লতাপাতায়।  

কেটে গেল বেশ কয়েক বছর। কয়েকজন স্বনামধন্য প্রযোজকের সঙ্গে কাজের সুবাদে সামান্য নামডাক হল। গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান হল সারা বছর ধরে কোন না কোন প্রজেক্টে লিখে; সঙ্গে বৃষ্টি রাতের পারানি – সামান্য সিঙ্গল মাল্টের। আমি আর দেরি না করে পরিবার’কে চটপট মুম্বাই আনিয়ে নিলাম। নিজের বউ’র চরিত্রে আমার অগাধ আস্থার ছিটেফোঁটাও যদি নিজের প্রতি থাকত। না থাকায় আমরা সবাই পাকাপাকি ভাবে মুম্বাইকার হয়ে গেলাম। 

কিন্তু মাথা থেকে সুমিতের সঙ্গে কাজের ইচ্ছেটা একেবারে গেল না। ততদিনে সুমিত সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। খোঁজ পাই আজকাল টেলিভিশন আর করে না। প্রডিউসারের চাপে একটা দক্ষিনী ফিচার ফিল্মের বাংলা রিমেক করেছিল। ভেবেছিল সেটা দিয়ে বাকি শিঁকে ছিড়বে। কিন্তু না, হয়নি। খবর দেখলাম সুমিত ওয়েব সিরিজ করছে। খুব খুশী হলাম; মুম্বাইয়ে বসে বুঝতে পারছিলাম নেটফ্লিক্স আর অ্যামাজন ওরিজিনালস এর দৌলতে ওয়েব উইল বি দা নেক্সট বিগ থিং।

***

দ্বিতীয় পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন 

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!