tin bochor hoye gelo

হালকা একটা ঝড় বয়ে গেলো। সুচেতা ঘুম থেকে উঠে চায়ের জল বসালো। একটু পরেই বাবাকে চা দিতে হবে, জানলা দিয়ে দেখতে পেলো অনেক পলাশ বাগানে ঝরে আছে, বাবার পেয়ারের ছাগল প্যালারাম মন দিয়ে সেগুলো খাচ্ছে। আরামে প্যালার চোখ প্রায় বুঁজে গেছে, গেটের শব্দে চোখ তুলে দেখলো,বাগানের গেট খুলে অনীক আসছে, অনীককে দেখে সুচেতা প্যানে জলটা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলো। বউ মরে যাবার পর লোকটা কেমন যেন বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে, প্রায় রোজই বিকেলের দিকে বাবার কাছে আসে। খানিকটা গল্পস্বল্প করে আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায়। জলখাবার খাওয়ার সময়ও খুব আস্তেধীরে  খায় অনীক। পরোটা ছিঁড়ে তরকারি মুড়ে মুখে তুলতেও যেন তার অনীহা। টুকটাক করে সামান্য কিছুটা খেয়েই হয়ে যায় তার। অনীকের তুলনায় এই বয়সেও বাবা যথেষ্ট বেশী  খান, এমনকি সুচেতাও। আচ্ছা বাপু, কম করে খেলে কি বউ ফিরে আসবে? তাহলে শুধুমুধু শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? সন্নেসী সেজে থাকাই বা কেন?..ছিঁচকাঁদুনে পুরুষ দেখতে পারে না সুচেতা, ঢিলেঢালা পানা তার দুচোখের বিষ।বাড়ির ভিতর অনীকের গলা শুনতে পেল সুচেতা, বাবা তাহলে সদর খুলেছেন।  এ বাড়িটা এমনই যে খুব আস্তে কথা বল্লেও শোনা যায়। মনে মনে কথা বল্লেও পার পাওয়া   যায়না। অনীকের গলা অবশ্য ভারী। চা হয়ে গেছে, তিনটে কাপে ঢাললো সুচেতা। বড়টার গায়ে  নীল দিয়ে  এন.সি.সি লেখা আছে। পোস্ট অফিসে  চাকরি করা ছাড়াও জীবন আর যে দুটো কাজ খুব মন দিয়ে করেছেন বাবা, এন সি সি তার মধ্যে  এক নম্বর। অন্যটা হলো শয়,শয়ে দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা গল্পো পড়া। অনীক ও তো গোয়েন্দা গল্পের পোকা, দুজনের এত ভাব তো সেই জন্যই। বিরাট শব্দ করে বাড়ির উপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে গেল,  বকুলপুরে মিলিটারি প্লেনের ঘাঁটি  হবার পর থেকে এই এক জ্বালা হয়েছে, বিকেলের দিকে ছোট্ট ছোট্ট ইস্পাতের পাখিদের মতো ওরা মাথার উপর দিয়ে  ভীষণ শব্দ করে উড়ে যায়। সুচেতা দেখেছে, ঘন্টাখানিক পরে ফিরেও আসে। রোজ রোজ কোথায় যায় ওরা? চা গুলো জুড়িয়ে যাচ্ছে না তো?  শরীরটা আজকাল এত ক্লান্ত লাগে কেন, প্রায় একবছর ধরে, তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যাথা করে, সেটাও কেন হচ্ছে? সুশান্ত বাবুকে দেখানো হল,তিনি তো কিছুই করতে পারলেন না।শুধু একগাদা কিসব বড়ি খাওয়ালেন। আর পরীক্ষা করালেন। বাবা চিন্তা করবেন, তাই সুচেতা বলেছিলো ব্যাথা সেরে গেছে। কিন্তু ব্যাথাতো যায়নি।  বাবাকে আর চিন্তিত করতে চায়না সে, অনেক  তো সইলেন। মার চলে যাওয়া,  দাদার এক্সিডেন্ট,  সুচেতার স্বামী শোভনের  হারট ফেলিওর, নিজের  ছোটবেলার বন্ধু অজিতজেঠুর ক্যান্সার, যেন একটা মিছিল চলেছে। মেঘ করেছে দুপুর থেকে, হঠাৎ শন শন শব্দে  বাতাস বয়ে জাম,কাঁঠাল আর পলাশ গাছটা শিউরে উঠলো। তারপরেই আকাশ ভেঙে জল নামলো, তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করতে গিয়ে আকাশে প্লেনের গুড় গুড় আবার শুনতে পেল সুচেতা,  আর শুনলো পেছনে সেই হাসি, মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলো যে তার স্বামী শোভন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে। মুখে তার টুকরো একটু হাসি। শোভন বল্লো” চেতা,চল সময় হয়েছে”… ফিরে যেতে সুচেতার মনে হলো, সত্যি, এই দিনটাতেই তো ওই যুদ্ধের এরোপ্লেনটা হুড়মুড় করে তাদের বাড়ির  উপরই ভেঙে পড়েছিল। বাবা, অনীক, প্যালারাম আর সে নিজেও তো পুড়ে ঝামা হয়ে গিয়েছিলো,বাড়িটারও কিছুই দাঁড়িয়ে ছিলোনা। 

 

তিন বছর হয়ে গেল, তবু কেন যে বারবার আসতে হয়… 

error: Content is protected !!