কাছে, তবু কত দূরে

বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ার দরুন মাতৃভাষায় লিখতে বরাবরই ভালোবাসি। তারপর দীর্ঘ ১০ বৎসর সংবাদ প্রতিদিনএর মতো প্রথম সারির সংবাদপত্রে লেখার  কারণে লেখার অভ্যাসটা বজায়ই ছিল। পরবর্তীকালে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও কিছু আইন সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখার দরুন ভালবাসাটা বয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। পরবর্তীকালে, পেশাগত কারণে ব্যস্ততাটা বেড়ে যাওয়ায় ইচ্ছেমতো লেখার অভ্যাসটা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে বন্ধুদের প্রেরণায় ইচ্ছেটা আবার চাগিয়ে উঠলো। 

পেশাগত দিক থেকে আইনজীবী বলেই হয়তো সমাজ দর্পণে চিত্র টা দেখার অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছি। সম্পূর্ণ আইনজীবী এবং শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রায় ২৩-২৪ বছর এই পেশার সাথে যুক্ত থাকে অনেক মানুষকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসতে দেখেছি। সেই সব মানুষের মধ্যে জয়ের আনন্দ যেমন দেখেছি, হারার দুঃখও তেমন দেখেছি। তবে ঘরের মানুষকে হারানোর দুঃখর সাথে মনে হয় কোন কিছুর তুলনা চলে না। আমার পেশাদার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোন মানুষের যদি ঘর বা ঘরের মানুষকে নিয়ে কোন সমস্যা হয়, তখন কিন্তু সে প্রকৃত অর্থেই মানসিকভাবে সমস্ত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এটা ঠিক যে মনের মানুষের সাথে থাকার অপারগতা বা অসাচছনদতা যখন তার প্রতি ভালোলাগা থেকে ঘৃনায় রূপান্তরিত হয়, তখন কিন্তু লড়াইটা আরো কঠিন হয়ে যায়। আর দীর্ঘ বা স্বল্প লড়াইয়ের শেষে, যেহেতু পরাজয়টা উভয় পক্ষেরই হয়, তাই যন্ত্রণাটা কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ থাকে না দুটো মানুষের মধ্যেই, দুটো মানুষকে ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে তাদের কাছের মানুষগুলোর মধ্যেও। 

আইনজীবী হবার দরুন একাধিক প্রকাশক সংস্থার হয়ে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করার দরুন সত্য কাহিনী গুলো খাতায় বন্দি করার এবং প্রকাশনের সুযোগ পেলেও কখনোই তা  সময়ের অভাবে করে ওঠা হয়নি। আসলে মানুষের সমস্যা গুলোর বিজ্ঞাপনের ইচ্ছা নিয়ে কোনদিনও প্রকাশনের কথা ভাবিনি। কিন্তু, সবসময় মনে হয়েছে সমস্যা গুলো বড্ড চেনা। কিন্তু, উত্তরটা না জানার ফলে কিংবা না জানতে চাওয়ার ফলে কোনোদিনও সেগুলোর সমাধান হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের মানুষগুলোর সঠিক ভূমিকা গ্রহণের অভাবেই সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। পুরাণকালে যে সম্যসাগুলো দিদিমা, জেঠিমা বা মাসিমারা সহজেই সমাধান করে ফেলতেন, এখন নিউক্লয়ার পরিবারে খুব ছোট গন্ডির মধ্যে সমস্যা আর ছোট হয়নি, সুপরামর্শ গ্রহণে আপত্তির কারণে তা বেড়েছে অনেকগুণ। তাই সেই সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরন এবং তার সমাধান সাধারণের মধ্যে ভাগ করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই কলম ধরা। জানিনা, কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। তবে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারি, প্রতি চার কি পাঁচ জন বন্ধুর কিন্তু সমস্যাগুলো খুব চেনা মনে হবে। কারণ, এ তো তার বন্ধুর, কিংবা তার দিদির কিংবা তার পাশের বাড়ির দাদার সমস্যা।  

বর্তমানে মুম্বইয়ে চাকুরীরত সুনির্মল ছোটবেলা থেকেই শরীরচর্চা, খেলাধুলা করেই  বড় হয়েছিল। পরিশ্রম করেই সে বড় হয়েছে। তার মা নিজে প্রবাসী বাঙালি বলে চিরকালই ছেলেকে বড় করেছেন উদারতার মধ্য দিয়ে। স্বামী দারুন কিছু চাকুরী না করলেও পুত্র এবং কন্যাকে  সুনির্মলের মা কাবেরী দেবী কখনোই অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে দেননি। বরঞ্চ অর্থের প্রয়োজনীয়তা তার অপব্যবহার কিংবা মূল্যবোধের শিক্ষা টা ভালই দিয়েছিলেন। নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন অত্যন্ত অবস্থাপন্ন পরিবারে এবং বর্তমানে সেই মেয়ে তার পুত্র এবং দুই কন্যা নিয়ে যতৎপরনাস্তি সুখী। ছেলের বিয়ের সময় কখনোই অর্থবান পরিবার না খুঁজে বিয়ে দিয়েছিলেন এক  মধ্যবিত্ত পরিবারেই। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে রঞ্জনা রুচিশীলা, সুশ্রী এবং শিক্ষিতা। 

বিবাহের পর শুরুর দিকটা ঠিকঠাকই কাটছিল। বিবাহের অনতিবিলম্বে কন্যাসন্তানের জন্ম দিল সুনির্মলের স্ত্রী রঞ্জনা। সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর দীর্ঘ আড়াই মাস কেটে গেলেও রঞ্জনা কে সুনির্মল আনতে পারল না তার বাড়িতে। সুনির্মল শ্বশুর বাড়িতে গেলে যথেচ্ছ আপ্যায়ন পেলেও তার বাড়িতে ফেরার কথা বললেই রঞ্জনা কোন না কোন কারণে চাইত দিনটাকে পিছোতে। প্রাথমিকভাবে সুনির্মল সহজভাবে নিলেও সময়ের সাথে সাথে অনুভব করতে লাগলো রঞ্জনার অনিচ্ছাটা। ক্রমে ক্রমে সুনির্মল এর মনে দানা বাঁধতে লাগলো অসন্তোষের ছায়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সুনির্মল এর বাবা ও মা ক্রমশ অনুভব করতে শুরু করলেন যে রঞ্জনার অনিচ্ছার প্রবলতাকে। শুরুর দিকের বোঝানোর ইচ্ছাটা কিংবা মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতাটা ক্রমশ কমতে লাগলো সুনির্মলের। তার বাবা-মার প্রতি রঞ্জনার অবহেলা এবং সর্বোপরি রঞ্জনার মা ও বাবার সম্পূর্ণ নীরবতা কিংবা এড়িয়ে চলা টা তাদের সবার কাছে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠলো। ইতি মধ্যে পারস্পরিক বাদানুবাদ সমস্যাকে করে তুলল আরো গুরুতর। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সুনির্মল ও  রঞ্জনার এতদিন যে বিষয়গুলো নিয়ে কোন সমস্যাই ছিল না, সেগুলো আরো বড় হয়ে উঠতে লাগলো। সুনির্মল এর কর্মস্থল মুম্বই কিংবা তার বাবার বাড়ি কলকাতা কোন জায়গায়ই  রঞ্জনার কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। 

বিদেশে স্থানান্তরিত হবার সাথে পদোন্নতির সম্ভাবনা থাকলেও সন্তানকে ফেরত নেওয়ার চ্যালেঞ্জে সুনির্মল ততদিনে সেই সুযোগকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু, তাতেও কোনো পরিবর্তন হলো না অবস্থার। সন্তানকে কাছ  ছাড়া করার ভয়ে আস্তে আস্তে সে চলে গেল সবকিছুর  বিরুদ্ধে। 

এত কিছুর মাঝেও সুনির্মল খুব অবাক হল রঞ্জনার বাবা ও মার সম্পূর্ণ নীরবতায়। ততদিনে মেয়ের সংসার ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা টা ক্রমশ বাড়তে থাকলেও তাদের সমস্যাকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা সুনির্মলকে ভীষন অবাক করে তুলল। কিন্তু কারণটা কি? কেন রঞ্জনা ফিরতে চায় না তার কাছে?   সকল  স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্বেও  বা রঞ্জনার এই সব কিছুকে এড়িয়ে যাওয়া সুনির্মলকে অবাক করে তুলল। তার এই সন্তানকে বিন্দুমাত্র কাছছাড়া করতে না চাওয়ার আগ্রহ সুনির্মলকে ভাবিয়ে তুলল। বিদেশের রঙিন জীবনের হাতছানি ও কেন রঞ্জনা কে আকর্ষিত করল না। তবে কারণটা কি?

(ক্রমশ)

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!