আদিনাথ এক সাদাসিধে, নির্বিরোধী ভবঘুরে। তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা জীবনের থেকে নিজেকে আলাদা করে, দূরে দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখা। ঠিক যেমন করে তটে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে কোনো এক পথভোলা পথিক। জীবনে দেখা বিভিন্ন চরিত্র, তাদের মান, অপমান, হাসি, কান্না সযতনে লিখে রাখে আদিনাথ।
মাঝে মাঝেই সন্ধেবেলায় হেদুয়ার যায় আদিনাথ, গিয়ে বসে পুব দিকের একটা নিরিবিলি বেঞ্চিতে। টিমটিমে আলোয় ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে ‘চরিত্র’রা। কেউ ফিরে দেখে না, কারুর সময় নেই। শুধু একটা চিনেবাদামওয়ালা ওদের চেনে, রোজ দেখা হয় ওদের সঙ্গে। আড়চোখে তাকায় আদিনাথের দিকে, কেমন যেন তালকাটা, ছন্নছাড়া।
আদিনাথের গা সওয়া হয়ে গেছে, অফিস শেষে পরস্ত্রীর শরীরে শরীর লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরিপাটি বাবু, তাদের সুখ দুঃখের কথা। অথবা জৈবিক তাগিদে তাড়িত ত্রিশোর্ধ লোকটার দীর্ঘশ্বাস। তার চোখের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়েছে, চশমার কাঁচটা হরলিক্সের শিশির তলার মত পুরু।
রাত নটার সময় পার্ক বন্ধ হয়, ক্লান্ত আদিনাথ পায়ে পায়ে হেঁটে বিবেকানন্দ মোড় পেরিয়ে আসে। ঠনঠনে পেরোবার সময় একটু সতর্ক আদিনাথ। এইতো গেলো পরশু একজন সমত্থ ভদ্রমহিলাকে গুঁতিয়ে দিল একটা ষাঁড়। চলতে থাকে আদিনাথ, শীতলা মন্দিরের সামনে এই সময়টায় অনেকে ‘চরিত্র‘ এসে ভিড় করে। ওরা এগিয়ে আসে, কথা বলে আদিনাথের সঙ্গে। আদিনাথ এগোয়, কালিকা থেকে একটা বেগুনি, একটা মোচার চপ সঙ্গে পাঁচ টাকার মুড়ি কিনে খায়। তারপর রাস্তার টিউয়েল থেকে অনেকটা জল খায়। ব্যাস কাল সকাল পর্যন্ত খিদে পাবে না।
এরপর নিতাইয়ের বন্ধ বুক স্টলটার ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে পরে। কত শত ‘চরিত্র‘ চারিদিকে, সভ্য, অসভ্য, রং মাখা, উলঙ্গ, আরো কত রকম। মানুষ যে একেবারেই দেখা যায় না তা নয়। মাঝে মাঝে ট্যাক্সিতে লাল কাপড় ঝুলিয়ে পেশেন্ট পার্টি, অথবা ‘হারকাটা‘ গলির ঠিকানা জানতে চাওয়া ছদ্মবেশী। আদিনাথ লিখতে শুরু করে, লিখে চলে সারা রাত। তার লেখায় মানুষ ও চরিত্র‘রা বিভাজিত হয় দাড়ি ও শূন্যের দুপাশে। লেখনীর প্রতি দায়বদ্ধ আদিনাথ লেখে কত কবিতা, উপন্যাস, ব্যাঙ্গচিত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর, যখন ভোরের প্রথম ট্রামটা ঘড়ড়ড় ঘড়ড়ড় শব্দে ইউনিভার্সিটি স্টপ এ এসে দাঁড়ায়, তাতে চেপে বসে লেখক। মিশে যায় মানুষের ভিড়ে, যাওয়ার আগে হরিলুটের মত উড়িয়ে দেয় নিজের লেখাগুলো। কখনো কখনো ‘গল্প cloud’ কুড়িয়ে নেয় কিছু লেখা, পাঠকেরা পড়ে আলোর আঁধারে অন্য এক জগতের গল্প।