anyo jagat 2

এবার সময়কাল ১৯৯৮, তিন বান্ধবী রমিতা, অদিতা আর বনানী হঠাৎই ঠিক করলো দু রাতের জন্য শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাবে। সেখানে অদিতার একটা ছোট্টো মিষ্টি বাড়ি আছে, সারাবছর খালিই থাকে মাঝেমধ্যে বিদেশী ছাত্র ছাত্রী স্বল্প সময় এর জন্য এলে ভাড়া দেওয়া হয়। বনানী এই প্রথম শান্তিনিকেতন যাবে , এতদিন শুধু গদ্যে বা কাব্যেই জেনেছে কবির আশ্রমকে, অতএব খুবই উত্তেজিত সে। প্রসঙ্গত বলে রাখি অদিতা আর রমিতা স্কুলের বন্ধু আর রমিতা এবং বনানী র হৃদ্যতা কর্মসূত্রে। এই তিন জনের যোগসূত্র হলো রমিতা, বনানী কিন্তু অদিতাকে এই প্রথম দেখলো।

যথাসময়ে তিন বন্ধু হাওড়া থেকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের A C Chair Car এ উঠে বসলো, সঙ্গে অবশ্যই প্রচুর স্ন্যাকস। বনানী খুব পিটপিটে, এটা নোংরা , ওটাতে আঁশটে গন্ধ ইত্যাদি, তাই বন্ধুরা প্রচুর কথা শোনানো সত্বেও সে ট্রেন এর হকারের ঝালমুড়ি বা শসা কাটা এসব ছুঁয়েই দেখলো না, অদিতার বানানো অসাধারণ এগ স্যান্ডউইচ উইথ মাস্টার্ড অ্যান্ড মেয়নিজ আর বাড়ীর নানান মুখরোচক টুকিটাকি খেয়েই তৃপ্ত সে। এই কয়েক ঘণ্টার যাত্রায় অদিতা আর বনানী র মধ্যে ও ভালো ভাব জমে গেলো।

স্টেশন থেকে রিকশা করে তিন বন্ধু বিকেল বিকেল অদিতার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলো, ভারী সুন্দর সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটি দোতলা বাড়ী। মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল, তাই টুক করে গরম চা খেয়ে ই তারা ঘুরতে বেরোলো, অল্প বাজার ও করতে হবে। সব কিছু ভীষণ পরিছন্ন, মোড়ের ঝুপড়ি দোকানগুলোতে খেতেও কোনো অসুবিধা হয়না। বনানীর সব থেকে অবাক লাগছিল রিক্সাওলা , কাজের মাসী অথবা দোকানদার প্রত্যেকের বাংলা বলার ধরণ অত্যন্ত মার্জিত ! পরে অদিতা বললো যে এরা অনেকেই বিভিন্ন স্বনামধন্য শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের  বাড়িতে নানা রকম কাজ করার সুযোগ পেয়েছে এবং সহবৎ ও আরো অনেক কিছু শিখেছে। অল্প কিছু বাজার নিয়ে তাড়াতাড়ি ওরা বাড়ী ফিরে আসে, অদিতা তাদের রান্না করে খাওয়াবে।

মুরগীর মাংসটা হাত চেটে খেতে হলো, গাছের গন্ধরাজ লেবু দিয়ে ডাল ও অমৃত। কাল সকালেই বেরোবে আশপাশটা ঘুরতে, তারপর যাবে চির আকাঙ্খিত কবি গুরুর আশ্রমে। তিন বান্ধবী মাটিতে একটা মোটা গদি পেতে দোতলার মাঝের বড়ো ঘরটা তে শুয়ে পড়লো। এই ঘরে এটাচড বাথরুম। এই বার শুরু হলো তিনজনের মজার মজার সব গল্প, প্রেম, বিরহ, পরকীয়া কিছুই বাদ গেলনা। প্রাণ খুলে হাসলো তিন জন, বহু দিন পর। বনানী আবার হুবহু নকল করতে পারে আর অদিতা ভারী সুন্দর গান গায়, মাঝ রাত অবধি তাদের মজলিশ চললো। এর পর দুই বান্ধবী ঘুমিয়ে পড়লেও বনানীর চোখে ঘুম এলো না, সে আবার কোথাও গিয়ে চট করে ঘুমোতে পারে না।

রাত প্রায় দুটো হবে, বনানী শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে আর বান্ধবীদের মৃদু নাসিকা গর্জনে কৌতুক অনুভব করছে। হঠাৎ দেখলো ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটা কেমন তীব্র আলোয় ভরে গেলো, একটু অবাকই হলো সে, কিন্তু তার অবস্থা টা তখন আধো জাগরণের। তারা দরজার দিকে পা আর জানলার দিকে মাথা করে শুয়েছিল, দেখলো সেই দরজা দিয়ে গেরুয়া আলখাল্লা (বাউলদের মত) পরিহিত এক প্রৌঢ় মুখে হালকা দাড়ি, প্রবেশ করলেন এবং তাদের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে তিনজন কে দেখলেন, যাকে বলে “observe” করলেন। মুখের ভাব ঠিক যেন কারোর অবর্তমানে হঠাৎ বাড়িতে অতিথি এলে হয় সেরকম। সব ঠিক আছে দেখে মনে হলো যেন সন্তুষ্ট হলেন এবং একদম বনানীর ডান পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে জানলার দিক দিয়ে কোথাও বেরিয়ে গেলেন, বনানী যে ওনাকে দেখছে সেটা যেন দেখেও দেখলেন না। দেওয়াল ও জানলার ওপাশটা তখন আলোয় আলো, যেন কোনো বিয়ে বাড়ী! এর পরই বনানী উঠে বসে, চোখ কচলাতে কচলাতে ভাবে, এ কি রকম স্বপ্ন রে বাবা, আর ঘুমোলামই বা কখন? বাথরুমে গেলো সে, মুখে চোখে জল দিয়ে এসে এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ভাবতে ভাবতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লো।

“এই, ওঠ এবার, আর কত ঘুমোবি?” এক হাতে ধূমায়িত চা এর কাপ আর অন্য হাতে বনানীকে আলতো করে ঠেলে জাগিয়ে দেয় রমিতা। ওরা দুজনে অনেক সকালে উঠে রেডী। বনানী চা এর কাপ এ মুখ দিতে গিয়েই কাল রাত্তিরের সব কথা মনে পড়ে যায়। ও রমিতা কে সমস্তটা বলে,

“বল তো কি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, অথচ পুরো জেগেই তো ছিলাম!”

শুনতে শুনতে রমিতার মুখের অভিব্যক্তি বদলাতে থাকে, চোখ বিস্ফারিত, এক নিঃশ্বাসে সে শুধু বলতে পারে ” তুই মেসোমশাই কে দেখেছিস!”

“মানে? কে মেসোমশাই?”

“এখুনি নীচে চল আমার সঙ্গে!”

টানতে টানতে রমিতা বনানী কে নীচে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় এক বিশাল ছবির সামনে, একি দেখছে সে?? এই প্রৌঢ়ই তো এসেছিলেন কাল স্বপ্নে (?), এমন কি এক পোষাক, এক মুখ দাড়ি! বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বনানী! ওদিকে চেঁচামেচি শুনে অদিতা ছুটে আসে রান্নাঘর থেকে, বলে “কি করছিস তোরা বাবার ছবির সামনে?”

ধীরে ধীরে সমস্তটা তাকে বলে রমিতা, কারণ বনানী তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অদিতার থেকে এরপর যা জানা যায় তা হোলো, এই বাড়িটা মেসোমশাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তত্বাবধান করে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু বাড়ীটি তৈরী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান। শোনা যায় শুধু এই বাড়ির টানেই তিনি নাকি ফিরে ফিরে আসেন । উনি ওই বাউলের পোশাকেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। প্রতিবেশীরা অনেকেই নাকি সন্ধ্যের দিকে তাঁকে বাড়ির গেটের সামনে ওই পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। আশপাশের লোকজন এই নিয়ে অনেক কানাঘুষো ও করে থাকে, বান্ধবীরা ভয় পেতে পারে ভেবে ‌এ নিয়ে অদিতা তাদের আগে থাকতে কিছু জানায় নি।

অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনজন তিনজন কে জড়িয়ে ধরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এই অভিজ্ঞতা এই তিনজন ছাড়া আর কারোর সঙ্গেই আলোচনা করা যাবেনা, শুধু ওরা তিনজন এক অন্য জগতের ছোঁয়ায় বিভোর হয়ে রইলো!

কল্যানী ঘোষ

(স্যান ডিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়া)
৩রা মে, ২০২০

প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

error: Content is protected !!